স্বামীর পরিণতির পথেই নার্গিস-নাজমারা!
রাজশাহী পাটকলের স্থায়ী শ্রমিক ছিলেন আবু সিদ্দিক। ২০১৭ সালের মে মাসে তিনি অবসরে যান। ঘুরে ঘুরেও পাননি গ্র্যাচুইটি-প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা। অর্থাভাবে নিজের চিকিৎসাও করাতে পারেননি। রোগে ভুগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে মারাই যান আবু সিদ্দিক। শ্রমে-ঘামে আয় করা টাকা পাওয়া তো দূরের কথা, মৃত্যুর আগে পাটকলে নিজের পাওনা টাকার পরিমাণটাও জেনে যেতে পারেননি।
প্রয়াত আবু সিদ্দিকের নমিনী স্ত্রী নার্গিস বেগম। জটিল রোগে তিনিও শয্যাশয়ী। টাকা না পাওয়ায় আক্ষেপ রয়েছে তারও। তার শঙ্কা-হয়তো জীবদ্দশায় স্বামীর পাওনা টাকা তিনি পাবেন না। তার প্রশ্ন টাকার অভাবে তাকেও কি বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে?
বিজ্ঞাপন
পাটকল সংলগ্ন রাজশাহীর কাটাখালী পৌর এলাকার সমসাদিপুরে প্রয়াত আবু সিদ্দিকের বাড়ি। দুই সপ্তাহ রাজশাহী ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরেছেন নার্গিস বেগম। হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন ঠিকই কিন্তু বাড়িতে পড়ে আছেন ওষুধ-পথ্যবিহীন।
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই নার্গিস বেগমের। বিছানায় শুয়েই তিনি কথা বলেন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। স্বামীর পাওনা টাকা দ্রুত পরিশোধে করুণ আর্তিও জানান।
বিজ্ঞাপন
তিনি জানান, বিনা চিকিৎসায় বিছানায় পড়ে গেছেন। দুই ছেলে দিনমজুর। কোনো রকমে দু বেলা ভাতের জোগাড় করছে ছেলেরা। অসুস্থ হয়ে ১২ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ করেছে ছেলেরা। এখন তাদের আর চিকিৎসা চালানোর সামর্থ্য নেই। সব মিলিয়ে তিনি খুব কষ্টে আছেন। এই কষ্ট মিলের লোকজন কিছুতেই বুঝতে চাইছে না। স্বামী বেঁচে থাকলে হয়তো তার এমন কষ্ট হতো না।
নার্গিস বেগমের ছেলে শাহিন আহম্মেদ জানান, প্রায় এক দশক ধরে তার মা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। এখন তিনি চোখে দেখতে পান না। কিডনিতেও সমস্যা ধরা পড়েছে। আরও নানান শারীরিক জটিলতাও রয়েছে মায়ের। দুই ভাই ধার-দেনা করে চিকিৎসা চালাচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় আর কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছে না। জুটমিলে পাওনা চাইতে গেলে তারা টাকা দিচ্ছে না। কত টাকা পাওনা রয়েছে সেটিও জানাচ্ছে না। কেবল বিজেএমসি এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের দোহাই দিয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছে।
কাটাখালীর সমসাদিপুর এলাকার বাসিন্দা নাজমা বেগমও। তার জীবনের আখ্যান মিলে যায় নার্গিস বেগমের সঙ্গে। নাজমা বেগমের স্বামী প্রয়াত শের মোহাম্মদ রাজশাহী পাটকলের স্কিনিং বিভাগের লাইন সর্দার ছিলেন। শের মোহাম্মদ অবসরে যান ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি। তিনি মারা গেছেন ২০২০ সালের ২৯ মে। অর্থাভাবে তিনিও এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান। চিকিৎসার অভাবে তার স্ত্রী নাজমা বেগম দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন এক চোখে।
নাজমা বেগমও শোনান নিজের সীমাহীন দুর্ভোগের কথা। তিনিও অপেক্ষায় আছেন স্বামীর পাওনা টাকার। তিনি জানান, মিলের ভেতরে তারা ঢুকতেই পারেন না। ম্যানেজারের সঙ্গেও কথা বলার সুযোগ নেই। কয় টাকা পাবো সেটিও জানতে পারেননি। একমাত্র ছেলে খুব কষ্ট করে সংসারের হাল ধরেছে। করোনার ভেতরে ছেলের চাকরি ছিল না। খেয়ে-না খেয়ে দিন গেছে। কেউ খোঁজও নেয়নি।
প্রয়াত শের মোহাম্মদের মেয়ে শিল্পী আক্তার জানান, তারা তিন বোন ও এক ভাই। পাটকলে সামান্য বেতনে চাকরি করে বাবা তাদের পড়ালেখা করিয়েছেন। চাকরির আয় থেকেই বাড়ি করার জন্য দুই কাঠা জমি কিনেছেন। কিন্তু তার সেই আশা পূরণ হয়নি।
শিল্পী জানান, অবসরে গিয়ে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অর্থাভাবে ভালোমতো চিকিৎসাও করানো যায়নি। এক রকম বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। অবসরকালীন টাকা পেলে তার চিকিৎসা করানো যেত। এখন মা অসুস্থ। মায়েরও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কিন্তু দেখার কেউ নেই।
রাজশাহী পাটকলের সাহায্যকারী ছিলেন সাইফুল ইসলাম। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর রাতে প্রতিদিনের মতো কাজ শেষে মিল থেকে বাড়ি ফেরেন। অসুস্থ হয়ে ওই রাতেই সাইফুল ইসলাম মারা যান। চার ছেলে-মেয়েসহ স্ত্রী আমিনা খাতুনকে ভাসিয়ে যান দুঃখের সাগরে।
থাকেন কাটাখালীর এমাদপুর নতুনপাড়া এলাকায় শ্বশুরের সংসারে। কথা হয় তার সঙ্গে। আমিনা জানান, তার চার ছেলে-মেয়ে। কোলে দুই বছরের শিশু সন্তান। স্বামীর মৃত্যুর পর কিছুই পাননি পাটকল থেকে। সন্তানদের খাওয়া-পরা ও পড়ালেখা সবই থমকে গেছে।
আমিনা খাতুনের শ্বশুর আব্দুল মজিদ পাটকলের মেক্যানিক্যাল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক ছিলেন। তিনি জানান, নিজের অবসরের পর ছেলে পাটকলে যোগ দেয়। প্রায় আট বছর চাকরি করেছিল। সাহায্যকারী পদে কর্মরত অবস্থায় ছেলে মারা যায়। পাটকলে তার পাওনা ৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। কবে সেই টাকা পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই।
কেবল নার্গিস, নাজমা কিংবা আমিনা নন, এমন ৯৯ জন মৃত পাটকল শ্রমিকের পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। এর বাইরেও বদলিসহ নাম জটিলতায় আরও প্রায় ৫০০ শ্রমিকের জীবনের চাকা থমকে গেছে। অনেকেই দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রাজশাহী পাটকল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, এই পাটকলে ১ হাজার ২০৭ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এর মধ্যে ৫০০ জন অবসরপ্রাপ্ত এবং মারা গেছেন। পাটকল বন্ধের সময় কর্মরত ছিলেন ৭১১ জন শ্রমিক। বদলি শ্রমিক ছিলেন আরও ১ হাজার ৫০ জন। স্থায়ী শ্রমিকদের প্রায় সবাই নিজেদের পাওয়া বুঝে পেয়েছেন।
কিন্তু মৃত ৯৯ জন শ্রমিকের পরিবারকে পাওয়া বুঝিয়ে দেয়নি কর্তৃপক্ষ। নামের ভুল থাকা ১১ জন এবং বদলি ৩৩৩ জন শ্রমিকও তাদের পাওনা টাকা পাননি। একই দশা পাটকলের ৭০ জন। তাদের কে কত বছর চাকরি করেছেন, কত টাকা গ্র্যাচুইটি হবে, কত টাকা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে পাবেন, কত টাকা মজুরি কমিশন থেকে পাবেন- এসবের কোনো হিসাব দেওয়া হয়নি। পারিবারিক সঞ্চয়পত্র খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি দেয়নি কর্তৃপক্ষ। কারও কারও কাছে বাড়তি অর্থ আদায় করেছে।
এই শ্রমিক নেতা বলেন, বিভিন্ন সময় তারা পাটকল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে বসেছেন। তারা বরাবরই জানিয়েছে, অল্প দিনের ভেতরে পাওনা পরিশোধ করা হবে। মিল বন্ধের আগে সরকার কথা দিয়েছিল- তিন মাসের মধ্যে পাওনা পরিশোধের । এছাড়া পিপিপির আওতায় আবারো মিল চালু করে তাদের কাজে ফেরানো হবে। কিন্তু ২০ মাসেও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি।
সরাসরি এসব নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি রাজশাহী পাটকলের উপ-মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প প্রধান শরিফুল কবির। দপ্তরে গেলেও সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাক্ষাতে রাজি হননি। তবে মোবাইলে শরিফুল কবির বলেন, আমাদের প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিকের পাওনা পরিশোধ করা হয়েছে। যাদের পাওনা পরিশোধ হয়নি, আশা করা যায় তারাও তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবেন।
জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ শ্যামপুরে ৪৯ দশমিক ০২ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠে রাজশাহী পাটকল। স্বাধীনতার পর এটি জাতীয়করণ হয়। বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় পরিচালিত হচ্ছিল এই কারখানাটি। ২৬০ লুমের এই পাটকলের উৎপাদন ক্ষমতা ২১ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন। এখানে মূলত চিকন ও মোটা বস্তা তৈরি হতো।
২০২০ সালের ২ জুলাই রাত ১০টার দিকে এই পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। এতে বেকার হয়ে পড়েন কর্মরত হাজারো শ্রমিক। গোল্ডেন হ্যান্ডসেকে নিয়মিত কর্মীদের অধিকাংশই তাদের পাওনা পান। কিন্তু বাকিদের ভাগ্য ঝুলে যায়।
এসপি