ভালোবাসার স্ত্রী তার অনাগত সন্তানকে গর্ভে নিয়েই ঘুমিয়ে আছেন আমগাছের শীতল ছায়ায়। কোর্টের এজলাস বা খাসকামরায় কুরে কুরে খাচ্ছে স্ত্রীর স্মৃতিগুলো। এজলাসের সামনের নেমপ্লেটে পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী দুই বিচারকের নাম এখন শুধুই স্মৃতির অমর ট্র্যাজেডি। স্বামীকে আসতে হয় প্রতিদিন সেই এজলাসে। আর আদালতের পরতে পরতে স্ত্রীকে খুঁজে বেড়ান স্বামী।

বলছি ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সানিয়া আক্তারের কথা। সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঠিক ছয় মাস আগে ২০২১ সালের ২৮ জুলাই মাত্র ২৯ বছর বয়সে চিরতরে চোখ বন্ধ করেন তিনি। করোনায় লাখো মানুষ হারিয়েছে বিশ্ব। কিন্তু অনাগত সন্তানকে গর্ভে নিয়েই এত অল্প বয়সে এমন করুণ চলে যাওয়া সবাইকে কাঁদিয়েছে এখনো কাঁদাচ্ছে।

এমন ট্র্যাজেডি নিয়ে যাকে বাঁচতে হবে, তিনি ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এ এইচ এম ইমরানুর রহমান। তবে মহাবিচারক যে সানিয়ার এমন প্রস্থান লিখে রেখেছিলেন, তা ভাবেননি তিনি। গত ১৯ জানুয়ারি ছিল এই বিচারক দম্পতির তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। এদিন স্ত্রীকে পাশে না পেলেও স্ত্রীর প্রিয় জিনিসগুলো হাতড়ে, তার স্পর্শ নিয়েই দিনটিকে স্মরণ করেন ইমরান।

বিচারক সানিয়ার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায়। করোনা পরিস্থিতি ও লকডাউনের কারণে তার স্বজনরা দাফনের সময় আসতে পারেননি। কান্নাটুকুও করতে পারেননি। নিজেদের একটু শক্ত করে তিন মাস পর গত ২১ অক্টোবর মা, ভাই-বোন ও ছোট্ট সোনামণিরা তাদের প্রিয় ‘সানিমণি’র কবর দেখতে আসে। চোখের জ্বল আর মনের অব্যক্ত কথায় তাদের দেখা হলো সানিয়ার সঙ্গে।

ইমরানুর রহমান ও সানিয়া আক্তার উভয়ই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়েছিলেন। এই প্রতিবেদক একই বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ার কারণে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় যতটুকু জেনেছেন, তার সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণা ঢাকা পোস্টে তুলে ধরা হয়েছে পাঠকের জন্য।

বিয়ের আড়াই বছরে হাতে গোনা কয়েকটি দিন ছাড়া কখনো আলাদা থাকেননি ইমরান-সানিয়া দম্পতি। অথচ ছয় মাস হয়ে গেছে তারা আলাদা। স্ত্রীর বিয়োগব্যথা কাউকে বোঝাতে পারছেন না। তা যেন বুক আর গলা আটকে ধরে। তাই প্রতিমুহূর্তে স্ত্রীকে স্মরণ করেন কান্নার বহিঃপ্রকাশে।

আদালতের খাসকামরার এক কক্ষেই ছিল তাদের চেম্বার। দুপুরের খাবার সানিয়ার টেবিলেই একসঙ্গে খাওয়া হতো। কিন্তু খাওয়ার সময় সানিয়া নিজের চেয়ারে কখনোই বসতেন না। স্বামীকে নিজের চেয়ারে বসিয়ে নিজে বসতেন অপর পাশে। স্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া এমন শ্রদ্ধা কীভাবে ভুলবেন একজন স্বামী!

একদিন রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেয়ে এসেছেন দুজনে। রাত দুইটার দিকে ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে যায় ইমরানের। স্ত্রী জানতে চাইলে বলেন, খুব খিদে পেয়েছে। স্ত্রী তখন উঠে চুলায় চাল বসান। তবু স্বামীকে একবারের জন্যও বলেননি যে কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, সকাল হলেই তো রান্না করব।’ ফজরের নামাজ পড়ে রান্নাবান্না শুরু করতেন সানিয়া। স্বামী গৃহকর্মীকে দিয়ে রান্না করাতে বললেও স্ত্রী বলতেন, ‘আমার জামাইকে অন্য মানুষের হাতে কেন খাওয়াব?’

করোনার সময় স্বামীর জন্য কাপড়ের মাস্ক বানিয়েছিলেন স্ত্রী। পুরো করোনায় তা ব্যবহার করেছেন স্বামী। সেখান থেকে দুটি মাস্ক পড়ে আছে এখনো। জ্যোৎস্না রাতে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে চাঁদের আলো দেখতেন দুজনে। সানিয়ার লাগানো পর্তুলিকাগাছ বারান্দায় আজ ফুলসহ ফুটে আছে। ২০২০ সালে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়ে বাগেরহাট থেকে পর্তুলিকা নামক এই পুষ্পতরু কিনে আনেন সানিয়া। যেগুলো আজ সানিয়ার কবরে রোপণ করা হয়েছে।

ইমরান কবিতা লিখতেন নিয়মিত। তার লেখার সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন সানিয়া। ফেসবুকে কোনো লেখা পোস্ট করলে সানিয়াকে ট্যাগ করা বাধ্যতামূলক ছিল। না করলে রাগ করতেন। লেখার উৎসাহ দিতেন এবং কিছু লিখলেই শুনতে চাইতেন স্বামীর কণ্ঠে। 'আহুতি' নামে ইমরানের লেখা প্রথম কবিতার বইয়ের শেষ কবিতা ছিল তার জন্য।

দুজনের ছুটি নিয়ে চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও কক্সবাজারে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। জুডিশিয়াল সার্ভিসের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি তিন বছরে একটি বেসিক বোনাসসহ ১৫ দিনের ছুটি পাওয়া যায়। ইমরানের ছুটি নিয়ম অনুযায়ী হয়ে যায়, কিন্তু সানিয়ার যখন ছুটি অনুমোদিত হলো, তখন সানিয়া ছুটিতে যান চিরস্থায়ীভাবে। তাই ২০২০ সালের শেষ দিকে সুন্দরবন, বাগেরহাট ও ষাটগম্বুজ ঘুরতে যাওয়াই ছিল তাদের সর্বশেষ ভ্রমণস্মৃতি।

ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহার দিন শ্বশুরবাড়িতেই কাটিয়েছিলেন সানিয়া। পরে বাবার বাড়িতে যেতেন। একজন বিচারক হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের আড়াই বছরে বাবার বাড়িতে ঈদ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেননি কখনোই। ইমরান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ও খুব অবিডিয়েন্ট ছিল, খুব টেক কেয়ার করত, সাদা মনের মানুষ ছিল, সাদামাটা জীবন পছন্দ করত; কোনো বায়না বা চাহিদা ছিল না।’

ইমরানের অ্যাসিডিটির সমস্যা থাকার কারণে খাওয়ার বিষয়ে যত্ন নিতেন সানিয়া। ইমরানকে কোনো কাজে ঢাকা বা অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে সানিয়া খুব কান্নাকাটি করতেন। বাসা থেকে কোর্ট, কোর্ট থেকে বাসা দুজন একসঙ্গে অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করতেন।

সানিয়া সেলাই করা, পিঠা বানানো পছন্দ করতেন। নামাজ পড়তেন নিয়মিত। মাগরিবের পর সব সময় কোরআন তিলাওয়াত করতেন। সুরা আররহমান ছিল তার খুব প্রিয়। পড়তেন এবং মোবাইলে শুনতেন। এসব গুণ ইমরানকে মুগ্ধ করত। পাশাপাশি হিজাব ছাড়া কখনো বাইরে বের হতেন না।

শ্বশুরবাড়িতে গেলে গ্রামের মানুষ বিচারক বউকে দেখতে ছুটে আসতেন। সবাইকে আপন করে নিতেন। গ্রামের সহজ-সরল নারীদের জড়িয়ে ধরে কথা বলতেন। বিচারকাজ আর সংসারের ফাঁকেও শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতেন। প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে শ্বশুরবাড়ি, মামাশ্বশুরবাড়ি ও নিজের জাদের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন।

এই দম্পতির মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ২০২১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। সানিয়া জানতে পারেন তিনি সন্তানসম্ভবা। ৬ জুলাই শারীরিক পরীক্ষার জানতে পারেন, ছেলেসন্তানের মা-বাবা হচ্ছেন তারা। অনাগত সন্তানকে নিয়ে ইমরান ওই দিনই অপ্রকাশিত কবিতায় লিখেছিলেন, ‘সাফওয়ান সারীফ তূর্য, তুমি অসীম প্রেমের নিগূঢ় ছোঁয়া, তুমি হৃদয় গগনে সূর্য...’ এভাবেই তার কবিতার প্রথম অংশে সন্তানের নাম খোদাই হয়ে রইল।

ইমরান ‘দ্য ফাইনাল ডেস্টিনেশন আল-জান্নাহ ওয়া আন-নার’ নামে একটি বইয়ের অনুবাদ করেছেন। ফজরের নামাজের পর তিনি বারান্দায় টেবিল পেতে লিখতেন। তখন সানিয়া বলতেন, ‘এখন যত পারো লিখে নাও, বাবু আসার পর লিখতে পারবে না।’ উত্তরে স্বামী বলতেন, ‘আমার বাচ্চা আমার মতোই শান্তশিষ্ট হবে, সারা দিন ঘুমাবে।’

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই করোনা পরীক্ষা করেছিলেন। তখন ইমরান পজিটিভ হলেও সানিয়া নেগেটিভ ছিলেন। কিন্তু পরের সপ্তাহে পরীক্ষা করলে এবার ইমরান নেগেটিভ, আর পজিটিভ হন সানিয়া। ১৪ জুলাই বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় সানিয়াকে। ১৪ দিন থাকতে হবে হাসপাতালে। এ কদিন স্ত্রীর সেবাযত্ন করেই কাটিয়ে দেন ইমরান।

এ প্রসঙ্গে সানিয়ার ছোট ভাই যোবায়ের বলেন, আপা যখন অসুস্থ, তখনো দুজন দুজনকে ছাড়া কিছু বুঝতেন না। ভাইয়া দশ মিনিটের জন্য বাইরে খাবার আনতে গেলেও আপা ফোন করে তাড়া দিতেন দ্রুত আসার জন্য। ভাইয়াকে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারতেন না।

২৮ জুলাই সকালে ঘুম থেকে ওঠেন সানিয়া। ইমরানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তোমরা জেগে আছ কেন, আমার অবস্থা কী খারাপ?’ ওই দিনই কেবল পরিপূর্ণ ঘুম হয়েছিল তার। এরপর সকালে অল্প কটা ভাত খেয়েছিলেন। সকাল ১০টার একটু পরই খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন সানিয়া। তবু ইমরানকে একটুও নড়তে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু ইমরান দ্রুত চিকিৎসক ডাকতে যাচ্ছিলেন। শ্বাসকষ্টের মধ্যেও স্বামীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সানিয়া। ইমরানও পেছন ফিরে দেখেন সানিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। এটাই যে দুজনের শেষ দেখা, সেটা বুঝলে ইমরান হয়তো সরতেন না সানিয়ার পাশ থেকে। ১০ মিনিট পর যখন চিকিৎসক নিয়ে এলেন, ততক্ষণে সানিয়া অনাগত সন্তানকে নিয়ে পাড়ি দেন মহাকালের উদ্দেশে। ইমরানের আর্তনাদে তখন ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ।

এরপর দুপুরের মধ্যেই হাসপাতালের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। সানিয়ার মা ও ভাই-বোনকে শেষবারের মতো মরদেহ দেখাতে রাত সাড়ে ১২টায় নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ফ্রিজিং গাড়ি পৌঁছে যায়। এদিকে সানিয়ার পরিবারকে সান্ত্বনা দিতে ছুটে গিয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। সেখানে এক ঘণ্টা অবস্থানের পর রাত দেড়টায় সানিয়াকে নিয়ে গাড়ি ছুটল বরিশালের উদ্দেশে।

সকাল ৬টার দিকে গাড়ি পৌঁছাল বরিশালের মুলাদিতে। আড়াই বছর আগে যে বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছিলেন সানিয়া, ২৯ জুলাই দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে তারই জানাজার আয়োজন সেই বাড়ির উঠানে। করোনা ও বৃষ্টি উপেক্ষা করেও আড়াই শ লোক উপস্থিত হন বাড়ির উঠানে। সেদিন ঝালকাঠির জেলা জজও উপস্থিত হন সহকর্মীকে বিদায় দিতে।

এ এইচ এম ইমরান এখন স্ত্রীর ভালোবাসাকে চোখের জলেই বাঁচিয়ে রাখেন। আদালতের এজলাস, খাসকামরা, বাসা আর বারান্দা— সব জায়গায় স্ত্রীর স্মৃতিগুলোকে হাতড়ে বেড়ান। বাসার বারান্দায় চাঁদ দেখার সেই মাদুর, প্লাস্টিকের টবে লাগানো পর্তুলিকাগাছ, পড়ার টেবিল, আল কোরআন, মোবাইল (হ্যান্ডসেট), ল্যাপটপ, হাতে বানানো মাস্কের মতো সানিয়ার সব জিনিসে স্পর্শ খুঁজে পান।

সানিয়া আক্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি অনার্সে ৩.৪৯ সিজিপিএ অর্জন করেছিলেন। ফলাফল বের হওয়ার আগে এপিয়ার্ড দেখিয়ে আবেদন করেছিলেন জুডিশিয়াল সার্ভিসের জন্য। আর প্রথমবারের চেষ্টায় বিচারক হয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম করেন। স্কুল ও কলেজজীবনেও ফল ছিল ঈর্ষণীয়। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ডোমারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে এবং শম্ভুপুরা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন তিনি। 

পরিবারে সানিয়ারা ৩ ভাই ও ৫ বোন। সবার মধ্যে সানিয়া চতুর্থ। তিনি শম্ভুপুরা উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ এবং ২০১১ সালে হাজী বেলায়েত হোসেন ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।

সেজ বোন কলেজশিক্ষক হামিদা আক্তার বলেন, এত দূরের পথেও কখনো ক্লাস মিস দিত না সানিয়া। সকালে কোনো দিন কাজের লোক না এলে ও এক ঘণ্টার মধ্যে সব রেডি করে ভার্সিটিতে চলে যেত। রাতে খাবারের টেবিলে ডাকার পরও দেখা যেত আমাদের খাওয়া শেষ হয়ে যেত, ও তখনো পড়ছে। একদম ছোটবেলা থেকেই সে পরিপাটি। ও বিচারক হওয়ার আগেই একজন ন্যায়বিচারক ছিল। আমরা দুটি দেহ কিন্তু একটি প্রাণ ছিলাম।

সানিয়ার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে অধ্যয়নরত যোবায়ের বলেন, আপু ছোটবেলা থেকেই আমাকে পড়াত। আমি বিরক্ত হলেও সে কখনো বিরক্ত হতো না। এমনও হতো, সারা রাতে একটি চ্যাপ্টার শেষ করিয়ে সকালে ফজরের নামাজ পড়েই সে আবার ভার্সিটিতে চলে যেত। যখন ও অসুস্থ হয়ে পড়ল, আমি বারবার আসতে চাইলেও আমাকে না করত। বলত, তুইও করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাবি। কিন্তু আমি যাওয়ার পর ও অনেক খুশি হয়। সব সময় বলত, ‘বাড়িতে যাব।’ আমি আর দুলাভাই বলতাম, সুস্থ হয়ে গেলে একসঙ্গে বাড়িতে যাব।

বড় ভাই মো. শাহিন কবীর কান্না করে বলেন, সানিয়ার শ্বশুর বলেছিলেন, আমি আমার মাকে তোমাদের ওখানে সমাহিত করতে চাই না। আমার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাব। আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছি, কিন্তু সানিয়ার স্বামী ও শ্বশুর অনড় ছিলেন। সবকিছু মিলিয়ে সবার মন সে জয় করতে পেরেছিল। আমরাও দোয়া করি আল্লাহর কাছে, আমার বোন যেন জান্নাতবাসী হয়।

সানিয়ার গর্ভধারিণী মা হাসিনা বেগম মেয়ের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান এখনো। তিনি বলেন, আল্লাহ তাকে পড়া শেষ হওয়ার আগেই চাকরি দিয়েছেন। আবার তাকে নিয়ে গেছেন। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ আমাকেও ধৈর্য দিন, তাকেও জান্নাত দিন। তিনি আরও বলেন, সানিয়া অসুস্থ হওয়ার পর শুধু বলত, ‘আমি ভালো হয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলব।‘ তারপর ঢুকরে ওঠা কান্নার কারণে আর কথা বলতে পারেননি হাসিনা বেগম।

সানিয়ার শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহ আলম মোল্লা বলেন, সানিয়া শুধু আমার পুত্রবধূই ছিল না, ও ছিল আমার মেয়ের মতো। আমি ওকে মেয়ে ছাড়া ভাবতাম না। ওর মতো উচ্চশিক্ষিত ও এত ভালো একটা মেয়ে, এত সুন্দর আচরণ সবার সাথে করেছে এবং কত অমায়িক ছিল, এটা আমি বোঝাতে পারব না। সানিয়ার শাশুড়ি কান্নাবিহ্বল হয়ে বলেন, ঝালকাঠির বাসায় এখন আর যাই না। কারণ গেলেই সানিয়ার সবকিছু মনে পড়ে, খুব কষ্ট হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সরকার আলী আক্কাস বলেন, সানিয়া আক্তার আমার একজন প্রিয় ছাত্রী ছিল। অসময়ে তার প্রয়াণ সহজেই মেনে নিতে পারছি না। আমার ডিপার্টমেন্টে বহু শিক্ষার্থী আসছে-যাচ্ছে, কিন্তু সানিয়ার প্রতি আমাদের ছিল অন্য রকম এক ভালোবাসা।

ব্যক্তিগত আলাপচারিতার শেষে পর্যায়ে ইমরান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সানিয়া বলত, যে কটা দিন নামাজ আদায় ও রোজা রাখতে পারিনি, তার কাফফারা দিয়ো তুমি। এখন প্রতি ওয়াক্তে দুই রাকাত নামাজ বেশি পড়ি সানিয়ার জন্য। কোরআন থেকে সুরা ইয়াসিন, মুলক ও আর রহমান পড়েন। ছুটি পেলেই ছুটে যান ঝালকাঠি থেকে বরিশালের মুলাদিতে প্রিয় স্ত্রীর কবর জিয়ারত করতে। প্রতি ওয়াক্তে কবরে দাঁড়িয়ে পড়েন সুরাহগুলো।

কবিতা লেখক সেই স্বামীকে এখন আর কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতে হয় না। কিন্তু প্রিয় স্ত্রীর কবরের সাদা টাইলসে মোড়ানো এপিটাফে নীল হরফে খোদাই করে দিয়েছেন কবিতার দুটি পঙক্তি— ‘...তুমি রবে মোর প্রার্থনা হয়ে স্বপনে ও জাগরণে/ তুমি রবে সদা জাগ্রত মোর মনের গহিন কোনে...।’

এনএ