ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের ঝিকরগাছার গদখালীতে সফলভাবে চাষ হচ্ছে শীতপ্রধান দেশের ফুল টিউলিপ। স্থানীয় ফুলচাষি ইসমাইল হোসেনের বাগানে ফুটেছে লাল, হলুদসহ চার রঙের টিউলিপ ফুল। ফুলের রাজ্যে প্রথমবারের মতো এই ফুল ফোটায় দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমাচ্ছে তার বাগানে। এতে করে এই অঞ্চলেল ফুলের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আগামী মৌসুমেই কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়বে টিউলিপ চাষ। 

ফুলচাষিরা বলছেন, টিউলিপের মাধ্যমে গদখালীতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। উন্নতজাতের এ ফুল চাষে সরকারি সহায়তা পেলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব।

জানা গেছে, সারাদেশের চাহিদার ৭০ শতাংশ ফুল সরবরাহ করছেন যশোর অঞ্চলের চাষিরা। এ অঞ্চলের ৬ সহস্রাধিক কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে জড়িত। নতুন জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরা উন্নতমানের ফুল উৎপাদন করছে। কয়েক দশকে ফুলের তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাহারি জাত। সর্বশেষ চলতি বছরে ঝিকরগাছার পানিসারা গ্রামের ইসমাইল হোসেনের কৃষি খামারে চাষ হয়েছে টিউলিপ ফুল। এর মাধ্যমে ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালীতে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। 

কৃষকরা বলছেন, বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে প্রতিবছরই গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন জাতের ফুল উপহার দিয়ে থাকেন। গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, লং স্টিক রোজের পর এবারের ভালোবাসা দিবসে ফুলপ্রেমীদের জন্য নতুন উপহার টিউলিপ।

কৃষি খামারের মালিক ইসমাইল হোসেন বলেন, এর আগে দেশে প্রথম বড় পরিসরে জারবেরা ফুল চাষ শুরু করেছিলাম। এখন জারবেরা ফুল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চাষ হচ্ছে। জারবেরা ব্যবহার হচ্ছে এখন প্রায় সব অনুষ্ঠানে। আসছে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে এবার জানুয়ারিতে পাঁচ শতক জমিতে টিউলিপের পরীক্ষামূলক চাষ শুরু করি। শীত মৌসুম দীর্ঘায়িত হওয়ায় টিউলিপ ফোটাতে কিছুটা ভোগান্তি হয়েছে। বীজ রোপণের ১৮ দিন পরেই টিউলিপের ফুল ফুটেছে। নেদারল্যান্ডসের এই ফুল বীজের প্রতিটির দাম পড়ে ৭০ টাকা। আর এক পিস টিউলিপ বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। সন্ধ্যা হলে বন্ধ আর সকাল হলেই মেলে যায় এই ফুল। 

তিনি আরও বলেন, গদখালিতে গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাসসহ বিভিন্ন ফুল ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে ভিন্ন সৌন্দর্যের টিউলিপ ফুলের ব্যাপক চাহিদা আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশের ফুলের বাজারে গোলাপসহ অন্যান্য ফুলের ভিড়ে ব্যাপকভাবে টিউলিপ ছড়িয়ে দিতে চাই। 

ইসমাইল হোসেন বলেন, এই দেশে টিউলিপের বড় বাজার তৈরি করা সম্ভব। বড় পরিসরে উৎপাদনে যাওয়াও সম্ভব। প্রথমে পরীক্ষামূলক চাষ করলেও এখন বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষ করার চেষ্টা করছি। তবে এখানে ফুল ফুটলেও পরবর্তীকালে রোপণের জন্য টিউলিপ গাছের বাল্ব সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বাল্ব সংরক্ষণ করতে হয়। তাই এটা টিউলিপ চাষের বড় সীমাবদ্ধতা। এছাড়া বিদেশ থেকে বাল্ব আনতেও উল্লেখযোগ্য অংকের শুল্ক লাগে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ইসমাইলের পাঁচ শতক জমির বাগানে টিউলিপ সারি সারি ফুটে রয়েছে। ওপরে পলিথিন ও ছোট ছিদ্রযুক্ত নেট দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে সূর্যের আলো। নিচে মাটিতে সানরাইজ, অ্যান্টার্কটিকা হোয়াইট (সাদা), লা বেলা রেড (লাল), মিল্কশেক রেড (লাল) এই চার প্রজাতির টিউলিপ ফুটেছে। ইউরোপের টিউলিপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বিভিন্ন স্থান থেকে সেখানে ভিড় করছেন দর্শনার্থীরা।

যশোর সরকারি এম এম কলেজ থেকে ফুলের রাজ্যে গদখালী ঘুরতে এসে অবাক সাকিব আলম মাহমুদ অনিক। প্রথমবার সরাসরি টিউলিপ ফুল দেখে বিমোহিত তিনি। তিনি বলেন, আগে গুগল-ইউটিউবে এই ফুল দেখেছি। সরাসরি দেখতে পেরে খুব ভালো লাগছে। 

মেয়ে-জামাইকে নিয়ে গদখালী ঘুরতে আসা যশোর নিউ মার্কেট এলাকার গৃহবধূ শাহানারা বেগম বলেন, আগেও গদখালীতে কয়েকবার এসেছি। গোলাপ-জারবেরাসহ নানা রকমের ফুলে দেখেছি। তবে টিউলিপ প্রথমবারের মতো দেখছি। এর আগে টিউলিপ ফুল হিন্দি সিনেমা বা ইউটিউবে দেখছি। সরাসরি এই ফুল দেখে সপরিবারে কয়েকটি ছবিও তুলেছি। এখানকার এই টিউলিপ চাষির কাছ থেকে দু-একটি চারা নিতে চাইছিলাম। তবে তিনি ফুল বিক্রি করলেও, চারা বিক্রি করবেন না বলে জানান। 

সোহেল হোসেন নাম এক এনজিও কর্মকর্তা টিউলিপের সৌন্দর্য উপভোগ করে বলেন, সারাদেশে ফুলের জন্য গদখালী পরিচিত। প্রথমবারের মতো এই ফুল চাষে এখানকার ফুলের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

পানিসারা এলাকার ফুলচাষি ইমামুল হোসেন বলেন, ৩০ বছর ধরে নানা জাতের ফুল চাষ করি। ইসমাইলের জমিতে টিউলিপ ফুল ফোটার পর থেকে প্রতিদিনই দেখতে আসছি। সন্ধ্যা হলে বন্ধ হয়ে যাওয়া আবার সকাল হলে মেলে যাওয়া বিষয়টি তার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। বাংলাদেশের মতো গরমপ্রধান দেশে টিউলিপ ফোটানো রীতিমতো সাধনার বিষয়। ইসমাইলের টিউলিপ চাষের মধ্যদিয়ে গদখালীতে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে টিউলিপ চাষের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারি সহায়তা পেলে আসছে বছরেই বৃহৎ পরিসরে টিউলিপ চাষ শুরু করব। 

গদখালীর ফুলচাষি মনজুর আলম বলেন, টিউলিপ সাধারণত শীতপ্রধান অঞ্চলের ফুল। চাষে সাধারণত ৫ থেকে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশের তাপমাত্রা যখন এই ফুল ফুটেছে, আমি মনে করি এই এই গদখালীতে এই ফুল চাষ করা সম্ভব।

ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ হোসেন পলাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন জাতের ফুল চাষের ইচ্ছা থেকেই কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বৃহত্তর কুষ্টিয়া ও যশোর অঞ্চল কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নেদারল্যান্ডস থেকে সরকারি খরচে সাত প্রকারের পাঁচ হাজার বাল্ব আমদানি করা হয়। ওই বাল্ব ইসমাইল হোসেনের ৫ শতক জমিতে গত ৬ জানুয়ারি রোপণ করি। ২২ জানুয়ারি থেকে ৪ জাতের টিউলিপ ফুল ফুটতে শুরু করেছে। 

তিনি আরও বলেন, আমরা ফুলের রাজ্য গদখালীকে মিনি নেদারল্যান্ডস হিসেবে পরিচিত করে তুলতে চাই। টিউলিপের প্রায় ১৫০টি জাত রয়েছে। যার মধ্যে বর্তমানে আট প্রজাতির চাষ হচ্ছে এখানে। ভবিষ্যতে আরও বাড়ানো হবে। 

জাহিদ হাসান/আরএআর