এইচএসসি পাস করে দিগবিদিগ ছোটাছুটি করেন। সংসারের হাল ধরতে কৃষিকাজ করেন। তাতেও হচ্ছে না। পরে ২০২০ সালে ৬০০ পিস সিডলেস লেবুর চারা দিয়ে সাড়ে চার বিঘা জমিতে শুরু করেন লেবু চাষ। প্রথম বছরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেন। এখন পর্যন্ত সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় আড়াই লাখ টাকা লাভ করেন যুবক মসিউর রহমান।

নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার সিরাজপুর ইউপি বসুলপুর গ্রামের বাসিন্দ মসিউর রহমান। তিনি ইউটিউবে লেবু চাষের ভিডিও দেখে উদ্বুদ্ধ হন। সিডলেস লেবুগাছ লাগানোর ছয় মাস পর থেকে গাছে লেবু আসা শুরু করে তিনি বলেন।

একসময় বরেন্দ্র অঞ্চলখ্যাত নওগাঁয় পানি-সংকটের কারণে বৃষ্টিনির্ভর আমন ধানের আবাদ ছাড়া আর কিছুই হতো না। পড়ে থাকত বিলের পর বিল, বিঘার পর বিঘা জমি। সময়ের ব্যবধানে এখন সেখানে দিন দিন বড়ই, আম, লেবু ও পেয়ারাসহ মৌসুমি ফলের উৎপাদন হয়। ফলে বিভিন্ন বাগান গড়ে উঠেছে। এতে এই অঞ্চলের কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, জেলায় লেবুর বাগান রয়েছে ১৭১.৫ হেক্টর জমিতে। উপজেলা ওয়ারী সদরে ২৫ হেক্টর, রানীনগর ২ হেক্টর, মান্দা ২ হেক্টর, ধামইরহাট ১২ হেক্টর, আত্রাই ১০ হেক্টর, পোরশা ৬ হেক্টর, সাপাহার৫.৫ হেক্টর,নিয়ামতপুর২৪হেক্টর, বদলগাছী ৬৫ হেক্টর, মহাদেবপুর১০হেক্টর, এবং পত্নীতলা ১০ হেক্টর জমিতে লেবু চাষ হয়।

উদ্যোক্তা মসিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এই জমিগুলোতে বৃষ্টিনির্ভর আমনের আবাদ ছাড়া আর কোনো ফসল হতো না। আর জমিতে যে খুব ভালো ধান হতো, সেটাও না। ভালো ধান না হওয়ার কারণে লেবু চাষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি ও চাষ করেছি। ইউটিউবে লেবু চাষের ভিডিও দেখে আমি চাষের জন্য উদ্বুদ্ধ হই। তারপর সাড়ে চার বিঘা জমিতে লেবু চাষ করেছি।

ভিডিও দেখার পর ২০২০ সালে আমি বদলগাছী কৃষি অফিস থেকে ২৫ টাকা করে ৬০০ চারা কিনেছিলাম। ছয় মাস পর থেকে গাছে ফল আসা শুরু করে। রোপণের প্রথম বছরেই ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার লেবু বিক্রি করেছি।

আস্তে আস্তে যখন লেবু বেশি ধরতে শুরু করল, তখন ৫০ থেকে ৬০ হাজার পর্যন্ত বিক্রি করেছি। দুই-তিন মাস পরপর এই বাগান থেকে লেবু বিক্রি করি আমি। পাইকাররা এসে কেউ শতকরা হিসাবে আবার কেউ হাজার হিসাবে কিনে নিয়ে যান। এসব লেবু স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তারা ঢাকায় পাঠান।

উদ্যোক্তা এ যুবক বলেন, ধান চাষে করতে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। খরচও বেশি হয় কিন্তু লাভের পরিমাণ পরিশ্রমের তুলনায় অনেক কম হয়। লেবুর চাষ করে ভালো লাভজনক হচ্ছে, এ জন্য লেবু চাষ করছি। আর লেবু চাষে পরিশ্রম কম হয়। সার, কীটনাশক কম দিতে হয়। লাভের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই লেবু চাষ করা আমার কাছে মনে হয় ভালো। ধানের মতো এত পরিশ্রম করতে হয় না।

লেবু চাষ করে আমি ভালোই লাভবান হচ্ছি। এ জন্য লেবু চাষ বাড়াচ্ছি। বাগান করার পরে থেকে সব ধরনের খরচ বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াই লাখ টাকা লেবু বিক্রি করে লাভ করেছি। এখন আমার লেবু বাগানে যে পরিমাণ লেবু ধরে আছে, এগুলো হালি ১৫ থেকে ২০ টাকা ধরে বিক্র করলে ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মতো বিক্রি হবে বলে আশা করি।

বেকার যুবকদের উদ্দেশে মসিউর বলেন, আমিও বেকার ছিলাম। ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করেছি। তবে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। সংসারের হাল ধরতে আমি কৃষিকাজে জড়িত হই। ধানের আবাদেও ভালো ফল পাচ্ছিলাম না। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই ভিন্ন কিছু করার। তারপর লেবু চাষ শুরু করি এবং সফল হই। তাই হতাশ হলে চলবে না। ভালো কিছু করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, সফলতা ধরা দেবেই।

সিরাজপুর এলাকাবাসী ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধান করতে যে পরিমাণ খরচ হয়, সবকিছু বাদ দিলে খড় ছাড়া আর কিছুই থাকে না। আর যদি একবার কারেন্ট পোকা আক্রমণ করে, তাহলে তো কথাই নেই। এসব কারণে অনেক কৃষক ধানের আবাদ বাদ দিয়ে বিভিন্ন ফলের আবাদে ঝুঁকছেন। এতে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। মসিউরের লেবুর বাগানের সফলতার গল্প শুনে এলাকার অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন বলে জানান তারা।

নিয়ামতপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমির আবদুল্লাহ মো. ওয়াহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় লেবুর চাষ হয়েছে ২৪ হেক্টর জমিতে। এই উপজেলায় বিভিন্ন জাতের লেবু চাষ করেছেন এখানকার স্থানীয় কৃষকরা। লেবু একটি লাভজনক হওয়ায় দিন দিন এর চাষ বাড়ছে। কৃষি অফিস থেকে আধুনিক প্রযুক্তিগত দিকসহ তাদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে।

তরুণ ও নতুন উদ্যোক্তাদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ যদি কৃষিকাজে নতুন উদ্যোক্তা হতে চান, তাহলে আমাদের কাছে শরণাপন্ন হলে আমরা তাদের প্রশিক্ষণ, ভালো বীজ, গাছ লাগানো, গাছে সার দেওয়াসহ কারিগরি সুযোগ-সুবিধা তাদের দেওয়া হবে।

এনএ