বরেন্দ্র অঞ্চলের এঁটেল-সমৃদ্ধ মাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলায়। এঁটেল ও এঁটেল দো-আঁশ মাটি ধান চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে এসব মাটিতে ধানের চারা উৎপাদনে তৈরি হয় নানা সমস্যা। যে কারণে এঁটেল মাটিতে ধানের চারা উৎপাদন করতে পারছেন না কৃষকরা।

এতে চলতি চাষাবাদে বিপাকে পড়েন তারা। তাই বাধ্য হয়ে কেনা চারা সংগ্রহ করতে হচ্ছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলার বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের।

কৃষকরা বলছেন, এঁটেল মাটিতে ধানের চারা উৎপাদন করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। চারা উৎপাদন করা গেলেও লাগানোর আগে বীজতলা থেকে চারা ঠিকমতো ওঠানো যায় না। এঁটেল মাটির কারণে বেশির ভাগই চারা নষ্ট হয়ে যায়। 

তবে এ বিষয়ে রাজশাহী মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিলুফার ইয়াসমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলের এঁটেল মাটির বৈশিষ্ট্য এমন যে শুকিয়ে গেলে অতিরিক্ত শক্ত হয়ে যায়। আবার একটু পানি পেলে অতিরিক্ত কাদা হয়ে যায়। তাই ধানের চারার জন্য সমস্যায় পড়তে হয় কৃষকদের।

এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় জানতে চাইলে মৃত্তিকাবিজ্ঞানী নিলুফার ইয়াসমিন বলেন, এসব মাটিতে অতিরিক্ত পরিমাণ জৈব সার দিতে হবে। তাতে খুব দ্রুত পরিবর্তন না হলেও কয়েক বছর পরে এসব জমিতে কৃষকরা ভালোমতো ধানের চারা উৎপাদন করে চাষাবাদ করতে পারবে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের বরেন্দ্র অঞ্চলের এই দুই উপজেলার কৃষকদের বেশির ভাগই ধানের চারা কিনে চাষাবাদ করেন। পাশের জেলা রাজশাহীর তানোর, নওগাঁর মান্দা, সাপাহার, মহাদেবপুর, নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে এসব ধানের চারা আনেন তারা। গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর, আড্ডা বাজার ও নাচোল উপজেলার নাচোল বাজার, হাটবাকইল বাজার, সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের শিমুলতলা বাজারে বসে ধানের চারার হাট।

পাশের জেলা রাজশাহী ও নওগাঁর মাটিও এঁটেল। কিন্তু সেখানে উৎপাদন করা হচ্ছে এসব চারা। পার্থক্য বিষয়ে কৃষি অফিস জানায়, ওই অঞ্চলে বিশেষ ব্যবস্থায় মাটিকে প্রক্রিয়াজাত করে ধানের চারা লাগানো হয়। তাই সেখানে চারা তোলার সময় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় না। তাই জেলার কৃষকরা সেদিকে নির্ভর হয়ে পড়েছেন।

এসব ধানের চারার হাটে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিক্রি হয় চারা। এ বছর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পোন দরে বিক্রি হচ্ছে ধানের চারা। ১৬০টি আঁটিতে এক পোন ধরে এসব ধানের চারা বিক্রি হচ্ছে। জিরা (ছোট), জিরা (লম্বা), স্বর্ণা, ব্রি-২৮ সহ বিভিন্ন জাতের ধানের চারা বিক্রি হয়।

নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের হাটবাকইল বাজারে ধানের চারা কিনতে এসেছেন পাশের গ্রাম গোসাইবাড়ির কৃষক রফিকুল ইসলাম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, বরেন্দ্র জমিতে ধানের চারা উৎপাদন করা যায় না, বিষয়টি তেমন না। উৎপাদন করা গেলেও এঁটেল মাটির কারণে চারা ওঠানো কষ্ট হয়। এমনকি অনেক সময় চারা নষ্ট হয়ে যায়। তাই আর ঝামেলা না করে প্রতিবছর কিনে নিয়েই চাষাবাদ করি।

পার্বতীপুর ইউনিয়নের জিনারপুর গ্রামের কৃষক রাসেল আলী জানান, এঁটেল মাটিতে চারা ওঠাতে অনেক সময় লাগে। এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি সময় লাগে। তাই এ অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষকই চারা কিনে চাষ করেন। চারা নষ্ট হওয়া ও চারা ওঠাতে সময় বেশি লাগার থেকে কিনে নেওয়াই ভালো সমাধান।

পাশের জেলা নওগাঁর মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়ার ধানের চারা বিক্রেতা ফারুক হোসেন বলেন, বোরো মৌসুমের প্রায় মাসখানেক সময় গোমস্তাপুর ও নাচোল উপজেলার বিভিন্ন মোড়ে ধানের চারা বিক্রি হয়। এই লক্ষ্যে আমরা শুধু ধানের চারা উৎপাদন করি। প্রতিবছরের এই সময়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব মোড়ে ধানের চারা বিক্রি হয়। দৈনিক ১০০০ থেকে ১২০০ আঁটি ধানের চারা বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।

কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলতি বছর ৪৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বেরো ধান চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত জেলায় ৪২ হাজার ১৬০ হেক্টর জমিতে ধানের চারা লাগানো সম্পন্ন হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৮৫ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

বরেন্দ্র অঞ্চলের নাচোল উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। চারা লাগানো হয়েছে ৭ হাজার ৯৬৫ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া গোমস্তাপুর উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার ২০৫ হেক্টর জমিতে। ধানের চারা লাগানো সম্পন্ন হয়েছে ১৩ হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড. বিমল কুমার প্রামাণিক ঢাকা পোস্টকে জানান, এঁটেল মাটিতেও ধানের চারা উৎপাদন করে ধান চাষাবাদ সম্ভব। এমনকি পাশের জেলা নওগাঁর বিভিন্ন উপজেলায়ও তারা বিশেষ ব্যবস্থায় চারা উৎপাদন করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জেও বরেন্দ্র অঞ্চলের দুই উপজেলার কৃষকরা চারা উৎপাদন করে। তবে বিশেষ ব্যবস্থায় চারার বীজ তৈরি করতে হয় বলে তা অনেকেই করতে চান না। কারণ বীজের জন্য অতিরিক্ত খাটুনি দিতে হয় এবং শতকরা ৮০ ভাগের বেশি ধান পরিপক্ব হতে হয়।

তিনি আরও জানান, ধানের চারা সাধারণত ২ থেকে ৩ ইঞ্চি নিচে যায়। তাই বালু ও জৈব সার দিয়ে ২ থেকে ৩ ইঞ্চি স্তর তৈরি করে বীজ বপন করে চারা উৎপাদন করা যায়। এতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। জেলার কৃষকদের এভাবে চারা উৎপাদন করতে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

মো. জাহাঙ্গীর আলম/এনএ