শুকনা মৌসুমে কৃষকের পানির সুবিধার্থে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নে কাঁকড়া নদীতে সরকার ২০০১ সালে একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করে। শুকনা মৌসুমে আরও বেশি পরিমাণে পানি ধরে রেখে সেচের সুবিধা বিবেচনায় ২০১৩ সালে উপজেলার মোহনপুরে আরও একটি রাবার ড্যাম নির্মাণ করা হয়।

ফলে শুকনা মৌসুমে দুটি রাবার ড্যাম চালু রেখে পানি ধরে রাখার মাধ্যমে আত্রাই ও কাঁকড়া নদীর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ মাঠ সেচের আওতায় এনে ফসল ফলানো হচ্ছে কয়েক বছর ধরে।

কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মোহনপুর রাবার ড্যামের বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ও বেলুনের পাইপে ফুটো হলেও কয়েক মাস ধরে বিল পরিশোধ ও বেলুন মেরামত করা হয়নি। ফলে সাঁইতাড়া ও মোহনপুর রাবার ড্যামের মধ্যবর্তী প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে এবার রোরো চাষ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা।

সরেজমিনে ভিয়াইল ও জয়পুর গ্রামে দেখা যায়, ইরি-বোরোর ভরা মৌসুমেও মাঠের পর মাঠ বিরান পড়ে আছে। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় চাষ করতে পারছেন না। নদীর পানিপ্রবাহের ওপর বালুর বাঁধ দিয়ে পানি আটকানোর চেষ্টা করছেন কয়েকজন কৃষক। জিজ্ঞাসায় তারা জানান, পানির অভাবে এখনো ধানের চারা রোপণ করতে পারেননি। তাই নদীর অল্প পানিটুকু আটকে লম্বা পাইপ দিয়ে মেশিনের সাহায্যে জমিতে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।

স্থানীয় কয়েকজন কৃষক বলেন, আগে নদীতে সব সময় পানি ছিল। কিন্তু দুই-তিন বছর ধরে বোরো মৌসুমে নদীতে পানি থাকে না। কারণ নদীতে পানি থাকলে বালুমহালের ড্যাম ট্রাকগুলো নদীতে নেমে বালু তুলতে পারে না। ফলে বালুমহালের ইজারাদার ও রাবার ড্যাম কর্তৃপক্ষ উজানের পানি আটকে রাখে, আর ভাটিতে পানি ছেড়ে দেয়। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

ভিয়াইল গ্রামের কৃষক ফজলুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভিয়াইল ইউনিয়নের হালকা সেচ প্রকল্পের আওতায় কাঁকড়া নদীর পানি দিয়ে প্রায় এক হাজার একর জমিতে বোরো মৌসুমে পানি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এবার উজানে উপজেলার সাঁইতাড়া ইউনিয়নের রাবার ড্যাম ফোলানো হয়েছে। কিন্তু অজানা কারণে মোহনপুর রাবার ড্যাম এবার ফোলানো হয়নি। কর্তৃপক্ষ বলছে, রাবার ড্যামটি নষ্ট, তাই ফোলানো হচ্ছে না। এতে আমরা নদীতে পানি পাচ্ছি না।

তিনি আরও বলেন, আমরা বোরো আবাদ নিয়ে এবার মহাচিন্তিত। আমাদের বোরোর বীজের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে। জমিতে রোপণ করতে পারছি না। এখন আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। এখন নতুন করে আবার জমির ধারে নতুন করে পানির বডিং করতে হচ্ছে। এদিকে তেলের দাম বেশি। কৃষকরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। তারা ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করেছেন বলে জানান।

কৃষক মমিনুল ইসলাম বলেন, আমি ১০ দিন থেকে ঘুরছি জমিতে পানি নেওয়ার জন্য কিন্তু নদীতে পানি না থাকায় বোরোর আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। নদীর সামনের দিকে সাঁইতাড়া রাবার ড্যামে পানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পেছনে মোহনপুর রাবার ড্যামে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য আমরা নদীতে পানি পাচ্ছি না। এ অল্প সময়ের মধ্যে পানির জন্য বডিংও করতে পারছি না। আমি বোরোর আবাদ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি কী যে করব আর কী যে হবে এবার।

কৃষক সামসুল হক বলেন কাঁকড়া নদীতে পানি না থাকায় আমরা জমিতে পানি পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত জমি ভেজাতে পারি নাই সময় পিছিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের বিকল্প ব্যবস্থা করে জমিতে পানি নিতে হচ্ছে। এখন খরচটা বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

জয়পুর গ্রামের কৃষক মোকসেদুল বলেন, আমি সাত দিন ধরে জামিতে পানি নেওয়ার জন্য ঘুরতেছি। এখনো জমিতে পানি নিতে পারি নাই। যেখানে আগে এক দিনে পানি নেওয়া যেত। কী কারণে নদীতে পানি নেই, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার জন্মের পর থেকেই দেখেছি নদীতে পানি থাকে। শুকনা মৌসুমেও পানি শুকায় না। এবার অজানা কারণে নদীতে পানি নাই। আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানালে তারা আমাদের জানায়, মোহনপুর রাবার ড্যাম নষ্ট, এ জন্য রাবার ড্যামের বেলুন ফোলানো যাচ্ছে না। তাই নদীতে পানি নাই। কিন্তু আমাদের সাঁইতাড়া রাবার ড্যামের পানি যদি নদীতে সমানভাবে দেওয়া হয়, তাহলে নদীতে সারা বছর পানি থাকবে।

জয়পুর কাঁকড়া নদীর বিএডিসি সেচ পাম্পের পরিচালক রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, নদীতে পানি না থাকায় প্রায় ৫০ একর বোরো জমিতে পানি দিতে পারছি না। কৃষকরা ঘুম হারাম করি দিয়েছেন। নদীতে পানি না থাকলে আমি কেমন করে তাদের জমিতে পানি দিব? আমি বিষয়টি চিরিরবন্দর ইউএনও স্যার ও কৃষি স্যারকে অবহিত করছি।

ভিয়াইল হালকা সেচ প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমির খসরু ঢাকা পোস্টকে বলেন, কাঁকড়া নদী থেকে পানি তুলে ৮০০ থেক ৯০০ একরের একটি কমান্ডিং অ্যারিয়ায় বোরো মৌসুমে পানি সরবারহ করা হয়ে থাকে। এটা দিনাজপুর জেলার সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প। এবার ও আমরা প্রাথমিক অবস্থায় নদীতে যা পানি ছিল, তা দিয়ে প্রায় ৫০০ এক জমিতে পানি দিয়েছি। তখন আমাদের পাম্পগুলো ভালোই চলছিল। ইদানীং যখন ইরি-বোরো মৌসুম আরম্ভ হয়েছে, তখন নদীতে পানি নেই। তখন অধিকাংশ সময় পাম্পগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। নদীতে পানি না থাকায় আমরা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি।

নদী শুকিয়ে মাছ ধরার জন্য জলমহালদের সুবিধা দেয় ও বলু উত্তোলনের জন্য বালুমহালকে সুবিধা দেওয়ার জন্য একটি কুচক্রী মহল কাজ করে থাকে। আমরা ইউএনও ও কৃষি অফিসারকে বলেছি। তারা দ্রুত সমাধান করে দেবেন বলেন আশ্বস্ত করেছেন।

মোহনপুর রাবার ড্যামের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন পানি ব্যবস্থাপনা সমবায় সমিতির সভাপতি ইয়াছিন আলী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি গত জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব নিয়েছি। এখন দেখতে পাচ্ছি ড্যামের বিদ্যুৎ বিল বাকি। পাইপে ফুটো আছে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এখনো কোনো সমাধান পাইনি।

চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়িশা সিদ্দিকা মুঠোফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোহনপুর রাবার ড্যামটি সদর উপজেলার মাধ্যমে তত্ত্বাবধান করা হয়। কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনা করে বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিগগিরই সমাধান করা হবে।

এনএ