দুটি হাত ও একটি পা নেই। তাতে কী! সব বাধা পার করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেন তামান্না আক্তার নূরা। আর সেই স্বপ্ন পূরণে অনেক দূর এগিয়েছেনও তিনি। ডান পা দিয়ে কলমের আঁচড়ে উত্তরপত্র লিখে টানা চতুর্থবার পেয়েছেন জিপিএ-৫। প্রবল ইচ্ছাশক্তির ওপর ভর করে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনো তামান্নার গন্তব্য এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বপ্ন দেখেন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হবেন। আর সেই স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা দূর করেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা। মুঠোফোনে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। আশ্বাস দিয়েছেন তামান্নার স্বপ্ন পূরণে সহায়তার।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া আলীপুরের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পী দম্পতির তিন সন্তানের মধ্যে বড় তামান্না নূরা। তামান্না যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। রোববার প্রকাশিত ফলাফলে এসএসসির মতো এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনি।

এর আগে তামান্না ২০১৯ সালে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া জনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। একই ফল করেছিলেন পিইসি ও জেএসসিতেও। বাবা রওশন আলী ঝিকরগাছা উপজেলার ছোট পৌদাউলিয়া মহিলা দাখিল মাদরাসার (ননএমপিও) শিক্ষক। মা খাদিজা পারভীন গৃহিণী। ছোট বোন মুমতাহিনা রশ্মি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ভাই মুহিবুল্লা তাজ প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।

গত ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাসহ দুটি স্বপ্নের কথা জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন তামান্না। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার বিকেল ও সন্ধ্যায় পৃথক দুটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে অডিওকলে ফোন দিয়ে তামান্নাকে অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহেনা। একইসঙ্গে দুই বোন তামান্নার স্বপ্ন পূরনে যেকোনো সহযোগিতার আশ্বাস দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর তার বোন শেখ রেহেনার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পেরে দারুণ খুশি তামান্না। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলতে প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। প্রবল মধুর আবেগে থর থর করে কাঁপছিল আমার ভেতরটা। অনভূতিটা আপনাদের বোঝাতে পারব না। এতটাই আনন্দিত হয়েছিলাম হাসতে পারেনি। কেঁদে ফেলেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী আমাকে নিয়মিত ভালোভাবে পড়াশোনা এবং নিজের যত্ন নিতে বলেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী স্বপ্ন পূরণে পাশে থাকার আশ্বাস দেন। তিনি বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টে একটা আবেদন করার পরামর্শ দেন। ওই ট্রাস্টের মাধ্যমে সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন বলে জানান।

তামান্নাকে আলোকিত করার পেছনে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছেন মা খাদিজা পারভীন। অদম্য মেধাবীর কষ্টার্জিত ফলাফলে যখন শিক্ষক, এলাকাবাসীর মাঝে আনন্দ বইছে তখন দূরারোগ্য রোগে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন মা খাদিজা বেগম। মেয়ের ফলাফলের বিষয়ে জানতে চাইলে আনন্দে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, তামান্না যে সাফল্য নিয়ে এসেছে তা ভাবতেই আনন্দে কান্না করতে ইচ্ছা করছে। কান্না ধরে রাখতে পারছি না। মেয়েকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারব কখনো কল্পনা করিনি। মেয়েটা হয়তো আমার গর্ভে হয়েছে তবে সে সবার। দেশবাসীর কাছে ওর জন্য দোয়া চাই যেন সে লক্ষ্য অর্জন করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৩ সালের ১২ ডিসেম্বর তামান্নার জন্ম। ওর জন্মের পর কষ্ট পেয়েছিলাম। তামান্নারে নিয়ে চিন্তায় রাতে ঠিকমতো ঘুম হতো না, বসে বসে কত কেঁদেছি। প্রতিবেশিরা বলত, ‘ওরে নার্সদের কাছে বলে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেল। ও মতো মেয়ে নিয়ে কি করবা। কোনো কাজে আসবে না।’

কেউ ওরে কোলে নিত না। পরে ভেবেছি, ওকে কারও বোঝা হতে দেওয়া ঠিক হবে না। ৬ বছর বয়সে ওর পায়ে কাঠি দিয়ে লেখানোর চেষ্টা করলাম। কলম দিলাম। কাজ হলো না। এরপর মুখে কলম দিলাম, তাতেও কাজ হলো না। পরে সিদ্ধান্ত নিলাম, ওকে পা দিয়েই লেখাতে হবে। এরপর বাঁকড়া আজমাইন এডাস স্কুলে ভর্তি করালাম। মাত্র দুই মাসের মাথায় ও পা দিয়ে লিখতে শুরু করল। এরপর ছবি আঁকা শুরু করল।

খাদিজা জানান, মেয়ের পড়াশোনায় শারীরিক সীমাবদ্ধতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। ২০১৩ সালে পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় (পিইসি) জিপিএ-৫ পায় তামান্না। বৃত্তিও পায়। অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায়ও (জেএসসি) জিপিএ-৫ পায়। কঠোর পরিশ্রমে সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখে এসএসসি ও এইচএসসিতেও।

মেয়ের সাফল্যে খুশি বাবা রওশন আলী। তিনি বলেন, ‘তামান্নার জন্মের পর থেকে নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করতে হয়েছে আমাদের। তারপরও হাল ছাড়িনি। মেয়েটার জন্য ঠিকমতো কোনো কাজ করতে পারি না। সারাক্ষণ ওর দিকে খেয়াল রাখতে হয়। তামান্নার শ্রবণ ও মেধাশক্তি খুব ভালো। কাউকে পাশে রেখে তার হুবহু ছবি এঁকে নিতেন। তামান্নার আঁকা অনেক ছবি যশোরের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন তারা। সেই চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা কথা বলেছেন। আশ্বাস দিয়েছেন যেকোনো সহযোগিতা করার।

যশোরের জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান বলেন, তামান্নার বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে জেলা প্রশাসন তাকে সহযোগিতা করেছে। তামান্না আমাদের সমাজের অনুকরণীয়। সেইসঙ্গে অনুপ্রেরণার অনন্য উদাহরণ। তামান্নার স্বপ্ন পূরণে পাশে দাঁড়িয়েছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যা। আশা করি তামান্নার স্বপ্ন পূরণে আর কোনো বাধা থাকবে না। 

জাহিদ হাসান/এসপি