অভিনব কায়দায় পাকস্থলীতে করে ইয়াবা বহনের সময় ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করেছে র‌্যাব-১১। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদরের আমতলী বিশ্বরোডে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিকালে তাদের আটক করা হয়। এ সময় ২৩ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে র‌্যাব। 

মঙ্গলবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব-১১ এর কুমিল্লার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। 

তিনি জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার আমতলী বিশ্বরোড এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়। এ সময় একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে  ৯ শিক্ষার্থীকে আটক করে র‌্যাব। পরে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে এক্সরে করলে ওই ৯ শিক্ষার্থীর পেটের ভেতর অস্বাভাবিক বস্তু ধরা পড়ে। পরবর্তীতে চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ পদ্ধতিতে ওই শিক্ষার্থীদের পেটের ভেতর থেকে ২৩ হাজার ৯৯০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।

আটকরা হলেন- কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া থানার চরপাড়াতলা গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তোফায়েল আহমেদ (১৯), দত্তের বাজার গ্রামের আজিজুল ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম রিফাত (২২), চরফরদী গ্রামের মাজহারুল ইসলামের ছেলে সদ্য এইচএসসি পাস করা আশিকুল ইসলাম (১৯), পটুয়াখালীর সদর থানার পশুরবুনিয়া গ্রামের আবুল কালাম আজাদের ছেলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোহেল (২১), নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার পিজাহাতি গ্রামের কামরুল হাসানের ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী মিতুল হাসান মাহফুজ (২২), গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার আমবাগ গ্রামের মৃত মাছুদ ইসলামের ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম ইসলাম (১৯), ময়মনসিংহের পাগলা থানার বাকশি গ্রামের ফখরুদ্দিন পাঠানের ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী রিশাত পাঠান (২২), একই গ্রামের রতন মিয়ার ছেলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী মো. সেলিম (২২) ও নয়াবাড়ি গ্রামের আসাদ মিয়ার ছেলে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী মো. গোলাপ (২২)।

আটক বিরুদ্ধে মাদক মামলা দায়ের করে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
কোতোয়ালি মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সহিদুর রহমান জানান, মাদক মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে ওই ৯ জনকে আদালতে নেওয়া হলে বিচারক তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। 

এদিকে র‌্যাব জানায়, ময়মনসিংহের এক মাদক ব্যবসায়ী এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই টেকনাফ থেকে ইয়াবা বহন করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করতেন। তার গ্রুপের কয়েকজন ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গ্রেফতার হয়। পরবর্তীতে তিনি এলাকার তরুণদের টার্গেট করেন। প্রথমে তিনি সেলিমকে ম্যানেজ করার পর সেলিমের মাধ্যমে রিফাত, গোলাপ, রিশাদ, তোফায়েল ও আশিককে এ কাজে আসতে বাধ্য করেন। ওই মাদক ব্যবসায়ীর মহাখালীর বন্ধুর মাধ্যমে প্রথমে সোহেলকে এবং সোহেলের মাধ্যমে মিতুল ও সিয়ামকে মাদক পরিবহনের কাজে সম্পৃক্ত করা হয়।

 প্রথমে তাদেরকে গাঁজা ও ইয়াবা ফ্রিতে সরবরাহ করা হয় এবং মাদকের আসরে আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত করে ফেলা হয়। পরবর্তীতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রলোভন এবং উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়। মাদকাসক্ত হয়ে এই তরুণরা মাদকের টাকা সংগ্রহ করার জন্য ওই মাদক ব্যবসায়ীর দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রথম পেটের ভেতরে করে ইয়াবা বহন করে সফলভাবে তা ডেলিভারি দিতে সক্ষম হয় তারা। তবে তাদেরকে প্রাপ্ত টাকা না দিয়ে অর্ধেক টাকা ট্যাক্স হিসেবে রেখে দেন মাদক ব্যবসায়ীরা। ফলে এই তরুণরা তাদের কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পূর্বের কাজের ধারণকৃত ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে পুনরায় এই কাজ করতে তাদেরকে বাধ্য করা হয়।

আটকের পর ওই তরুণরা জানিয়েছেন, মাদক কারবারিদের নির্দেশে তাদের আব্দুল্লাপুরের একটি বাস কাউন্টারে যেতে বলা হয়। সেই কাউন্টারে আগে থেকেই তাদের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফগামী বাসের টিকিট কেটে রাখা হয়। বাস টেকনাফ গিয়ে থামলে সেখানে থাকা জনৈক মাদক কারবারি তাদের একটি আবাসিক হোটেলে নিয়ে যান। হোটেলের যে কক্ষে তাদের রাখা হয়, সেই কক্ষটি সারাদিন বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হতো।

সন্ধ্যা নাগাদ মাদক কারবারির দুই থেকে তিনজন লোক হোটেলে এসে ওই তরুণদের সঙ্গে দেখা করে এবং ইয়াবা পেটে বহন করার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। এক্ষেত্রে প্রথমে কলার রস দিয়ে খেজুরের মতো ছোট ছোট পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবার পোটলাগুলো পিচ্ছিল করে তারা গিলে ফেলে। এরপর নাইট কোচে তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। পথে সার্বক্ষণিক মাদক কারবারিরা তাদেরকে নির্দেশনা দিতে থাকেন। মাদক কারবারিদের নির্দেশনা অনুযায়ী ইয়াবাগুলো কখনো নরসিংদী, কখনো আশুলিয়া আবার কখনো মহাখালীতে নির্ধারিত স্পটে মাদক কারবারীদের নিকট পৌঁছে দিতে হয়।

আটকরা র‌্যাবকে আরও জানান, গত এক বছরে অসংখ্যবার তারা এ প্রক্রিয়ায় টেকনাফ থেকে ঢাকায় ইয়াবা এনেছে। পারিবারিক দৈন্যদশা, বেকারত্ব ও মানসিক অবসাদের কারণে মাদক কারবারিদের ব্ল্যাকমেইলিংয়ের ফাঁদে পা দিতে হয়েছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও কয়েকটি তরুণ শিক্ষার্থীদের গ্রুপ এ পন্থায় মাদক কারবারীদের নির্দেশনায় ইয়াবা আনা নেওয়া করে। 

র‌্যাব জানায়, এই প্রক্রিয়ায় ইয়াবা বহন করায় যে কোনো সময় মারাত্মক শারীরিক ক্ষতি, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ঝুঁকি জেনেও টাকার লোভে মাদক ব্যবসায়ীদের এমন ফাঁদে পা দিচ্ছে অনেক তরুণ।

অমিত মজুমদার/আরএআর