আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার) নির্দেশে ১৪ অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানে ঋণ বিতরণের নামে ৬১৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে আত্মসাৎ করা অর্থের গতিপথ আড়াল করার জন্যই এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে।

নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, এমএসটি ফার্ম অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেডের ঠিকানা একই। যা অস্তিত্বহীন। এ আট প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩১ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।

অন্যদিকে বর্ণ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও সন্দীপ করপোরেশন নামের ছয় প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা একই। যার বিপরীতে ২৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছে।

গতকাল বুধবার (২ মার্চ) ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাসেল শাহরিয়ারের বক্তব্যে উঠে আসে এমন তথ্য। এ সময় দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান উপস্থিত ছিলেন।

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলায় গত ১৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার হন রাসেল। এরপর আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ১ মার্চ ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের দ্বিতীয় দিনে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে রাজি হন রাসেল শাহরিয়ার। তিনি দুদকের ১৩টি মামলার আসামি।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে রাসেল শাহরিয়ার যা বলেন

রাসেল শাহরিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ১৯৮৯ সালে খিলগাঁও হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৯১ সালে তেজগাঁও কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ১৯৯৪ সালে বুয়েটে ভর্তি হন। ১৯৯৮ সাল বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করে ১৯৯৯ সালে বেসিক ব্যাংকে যোগ দেন। ২০০৫ সালে ইউনাইটেড লিজিংয়ে যোগ দেন। ২০০৬ সালে আইআইডিএফসিতে যোগ দেন। তখন তার অপারেশন হেড ছিলেন আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার)। ২০০৮ সালে রিলায়েন্স লিজিংয়ে এমডি হিসেবে পি কে হালদার যোগ দেন। এরপর রাসেল শাহরিয়ার ২০১৪ সালে আইআইডিএফসিতে এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০১৪ সালের জুন মাসে মাইডাস ফাইন্যান্সের ডিএমডি হিসেবে যোগ দেন।

জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘ওই বছরের নভেম্বর মাসে পি কে হালদার তাকে এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি হিসেবে যোগ দেওয়ার জন্য ফোন দেন। পি কে হালদারের পরামর্শ মতে এফএএস ফাইন্যান্সে এমডি হিসেবে যোগ দেন। উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছিলেন পি কে হালদারের বিশ্বস্ত সহযোগী। তিনি ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আইআইডিএফসিতে সিএফও ছিলেন। পরে গোল্ডেন লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে এবং ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রিলায়েন্স ফাইন্যান্সে পি কে হালদারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

মাসিক তিন লাখ ২৫ হাজার টাকা বেতনে এফএএস ফাইন্যান্সের এমডি হিসেবে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে যোগ দেওয়ার কথা উল্লেখ করে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে রাসেল আরও বলেন, এমডি হিসেবে এফএএস ফাইন্যান্সে যোগ দেওয়ার সময় চেয়ারম্যান হিসেবে সেখানে ছিলেন এ হাফিজ, পরিচালক হিসেবে ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম, উজ্জ্বল কুমার নন্দী ও সিদ্দিকুর রহমান। ওই তিনজন এফএএস ফাইন্যান্সের বোর্ডে খুব প্রভাব বিস্তার করতেন। উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছিলেন পি কে হালদারের ডান হাত। ওই সময় নাহিদা রুনাই পি কে হালদারের নাম উল্লেখ করে রাসেল শাহরিয়ারের কাছে বিভিন্ন ফাইল সই করার জন্য যেতেন।

“বোর্ড সভায় উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সিদ্দিকুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম প্রায়ই বলতেন, ‘এগুলো বোর্ডের ফাইল, এগুলো নিয়ে আপনার চিন্তা করার কিছু নাই। এগুলোর দায়িত্ব বোর্ডের, আপনি নির্ভয়ে কাজ করেন।’ ক্রেডিট হেড হিসেবে প্রাণ গৌরাঙ্গ দে যোগ দেওয়ার পর উজ্জ্বল কুমার নন্দী গৌরাঙ্গকে ফোন দিয়ে ফাইল বোর্ডে নিতে বলতেন। করপোরেট হেড হিসেবে আহসান রাকিব যোগ দেওয়ার পর তারাই সরাসরি পি কে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফাইল নিয়ে আসতেন এবং পি কে হালদারের নির্দেশ মতো বোর্ডে ফাইল উপস্থাপনের জন্য নোট তৈরি করে তাতে স্বাক্ষর করতেন এবং আমাকে বোর্ডে উপস্থাপনের জন্য বলতেন।”

‘পি কে হালদার মাঝে মাঝে এফএএস ফাইন্যান্সের বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। আমার চেম্বারেও তিনবার এসেছিলেন তিনি। বোর্ডে ফাইল গেলে বলা হতো, এটি কি পি কে হালদারের ফাইল? পি কে হালদারের ফাইল বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একবাক্যে তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনুমোদন করে দিতেন।’

আরিয়ার কেমিক্যাল লিং, মীম ট্রেডিং করপোরেশন, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মুন এন্টারপ্রাইজ, এন্ডবি ট্রেডিং, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, বর্ণ, উইনটেল করপোরেশন লিমিটেড, স্বন্দীপ করপোরেশন, সুখদা প্রপার্টিজ লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল, আনান কেমিক্যাল লিমিটেড, নিউট্রিক্যাল লিমিটেড, নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ হলো পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তির মালিকানায় ছিলেন পি কে হালদারের আত্মীয় ও সহযোগীরা। এমএসটি ফার্মা অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেড, এমার এন্টারপ্রাইজ, মেরিন এন্টারপ্রাইজ, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড হলো নওশেরুল আলম ও বাসুদেব ব্যানার্জির স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। যারা পি কে হালদারের ব্যবসায়িক পার্টনারও।

জেড এ ট্রেডিং হাউস, ব্রিনান অ্যাপারেলস লিমিটেড হলো জাহাঙ্গীর আলমের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। নওশের, বাসুদেব, জাহাঙ্গীর, সিদ্দিকুর রহমান, উজ্জ্বল কুমার নন্দী ছিলেন পি কে হালদারের বিশ্বস্ত সহযোগী। এ সিন্ডিকেটই মূলত এফএএস ফাইন্যান্স লুট করেছে। আমি পি কে হালদার, উজ্জ্বল কুমার নন্দী, সিদ্দিকুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলমের চাপেই মূলত কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে কোনো মর্টগেজ না নিয়ে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে একক স্বাক্ষরে কিছু ফাইল বোর্ডে উপস্থাপন করি। বোর্ডে অনুমোদন পেলে পি কে হালদার ও উজ্জ্বল কুমার নন্দীর কথা মতো অনুমোদিত ঋণ হিসাবে টাকা বিতরণ না করে পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবে টাকা স্থানান্তরের নোট অনুমোদন দিই। ফলে ঋণের টাকা পি কে হালদারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট হিসাবে স্থানান্তরিত হয়- বলেন রাসেল শাহরিয়ার।

জবানবন্দিতে তিনি স্বীকারও করেন যে, পি কে হালদারের নির্দেশে অর্থের গতিপথ আড়াল করার লক্ষ্যে বিভিন্ন অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড হতে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করে অন্য প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করা হয়।

আরিয়ান কেমিক্যাল লিমিটেড, মীম ট্রেডিং, কণিকা এন্টারপ্রাইজ, মেরিনট্রাস্ট মুন এন্টারপ্রাইজ, এমার এন্টারপ্রাইজ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, বর্ণ, সুখদা প্রপার্টিজ, আনান কেমিক্যাল, দিয়া শিপিংয়ের নামে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের চেক ব্যবহার করা হয়। নিউটেক এন্টারপ্রাইজ, ন্যাচার এন্টারপ্রাইজ, দিয়া শিপিং, এমটিবি মেরিন লিমিটেড, এমার এন্টারপ্রাইজ, জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজ, মেরিন ট্রাস্ট লিমিটেড, এমএসটি ফার্ম অ্যান্ড হেলথ কেয়ার লিমিটেডর ঠিকানা একই। যা অস্তিত্বহীন। ওই আট প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৩১ কোটি ১৯ লাখ টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়।

অন্যদিকে বর্ণ, আরবি এন্টারপ্রাইজ, এসএ এন্টারপ্রাইজ, উইন্টেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, হাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও সন্দীপ করপোরেশনের ঠিকানা একই। এসব প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ২৮৫ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। মূলত পি কে হালদারের নির্দেশে অস্তিত্বহীন এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ দেওয়া হয়।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড থেকে ৫২৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৩ মামলার অনুমোদন দেয় দুদক। ভুয়া ও কাগুজে ১৩ প্রতিষ্ঠানের নামে জাল নথিপত্র প্রস্তুত করে অর্থ আত্মসাতের ওই ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ গত ২২ ফেব্রুয়ারি ১০৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আলোচিত পি কে হালদার ও এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও এমডিসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে তিন মামলা দায়ের হয়। বাকি আট মামলা শিগগিরই দায়ের হবে বলে দুদক সূত্রে জানা যায়।

ক্যাসিনো অভিযানের ধারাবাহিকতায় এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ওঠার পর এখন পর্যন্ত ২৮ মামলা দায়ের করে দুদক।

পি কে হালদার কেলেঙ্কারিতে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন ১২ জন। যাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারি, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

আরএম/এমএইচএস/এমএআর