দেশে বছরে মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিক্রি ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো। আর ফোন সেট উৎপাদন ও বিক্রি, সেলফোন সার্ভিস ও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেবা হিসাবে ধরলে কয়েক লাখ কোটি টাকার বাণিজ্য হয় এ সেক্টরে।

স্থানীয় মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমানে বড় ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট সুবিধা ভোগ করে। আমদানি করা হ্যান্ডসেটের তুলনায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও অ্যাসেম্বলড হ্যান্ডসেটের কর অনেক কম। মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাজারকে আরও বিকশিত করতে সরকার আগামী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটেও শুল্ক-কর ছাড়ের সুবিধা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।  

এ বিষয়ে এনবিআরের বাজেট সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে বাংলাদেশ ভালো করছে। আমরা চাই এ খাত পুরোপুরি স্বনির্ভর হোক। এ খাতের বিকাশে আগামী বাজেটেও শুল্ক, কর ও ভ্যাটে সব ধরনের সুবিধা অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত রয়েছে।

তিনি বলেন, যারা নতুনভাবে উৎপাদনে আসতে চায় তাদের কারখানা স্থাপনসহ বিভিন্ন স্তরে আমাদের সহযোগিতা থাকবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগানকে সামনে রেখে সরকারও চাচ্ছে এ খাত আরও বিকশিত হোক।

বর্তমানে স্থানীয়ভাবে মোবাইল হ্যান্ডসেট বা সেলুলার ফোন উৎপাদনে এইচএস কোডের বিপরীতে ৮৭ ধরনের কাঁচামালের ওপর প্রযোজ্য আমদানি শুল্ক মূল্যভিত্তিক ১ শতাংশের অতিরিক্ত শুল্ক এবং সমুদয় ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া আছে। এছাড়া, ১১ ধরনের কাঁচামালে প্রযোজ্য আমদানি শুল্ক মূল্যভিত্তিক ১০ শতাংশের অতিরিক্ত শুল্ক এবং সমুদয় ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া রয়েছে, যার মেয়াদ আগামী ৩০ জুন শেষ হবে।

বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী সমিতির (বিএমবিএ) তথ্যানুসারে, মোবাইল ফোন উৎপাদন ও অ্যাসেম্বলিং খাতে দেশে বর্তমানে ১২-১৪টি কোম্পানির বিনিয়োগ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি, যাদের উৎপাদন সক্ষমতা চার কোটি ইউনিটের বেশি। আর নতুন বিনিয়োগ নিয়ে উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে কেউ কেউ। কারখানা ও বিপণন মিলিয়ে কর্মসংস্থান এক লাখের বেশি মানুষের।

দেশে কারখানা গড়ে উঠেছে, এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে— স্যামসাং, নোকিয়া, ওয়ালটন, সিম্ফনি, টেকনো, ভিভো, শাওমি, অপ্পোসহ ১২-১৪টি ব্র্যান্ড। দেশের বড় শিল্পগ্রুপ ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স, ওয়ালটন, এডিসনের পরে বাজারে আসছে আরও অনেক কোম্পানি।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যানুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দুই কোটি ৯৪ লাখ হ্যান্ডসেটের মধ্যে প্রায় ৫১ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা হয়েছে। আর ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আমদানি করা ও উৎপাদিত হ্যান্ডসেটের সংখ্যা ছিল চার কোটি ১২ লাখ, যার মধ্যে প্রায় ৬৩ শতাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত।

২০২১ এর শুরুতে কিছুটা মন্দাভাব থাকলেও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ খাতে বিক্রির পরিমাণ জুলাই থেকে বাড়তে শুরু করে। মহামারি আঘাত হানার পরও এ খাতে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে মোবাইল ফোনের বিক্রি ও আয় যথাক্রমে ৮ ও ১৭ শতাংশ বেড়েছে। ভালো খবর হচ্ছে, স্থানীয় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে হ্যান্ডসেটের মূল্য প্রায় ৩৫ শতাংশ কমে এসেছে, যেখানে মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে পাঁচ বছর আগেও শতভাগ আমদানি-নির্ভর ছিল বাংলাদেশ।

২০১৭ সালে দেশে প্রথম মোবাইল উৎপাদন কারখানা স্থাপন করে ওয়ালটন। ওয়ালটনের পরই দেশে মোবাইল ফোনের কারখানা স্থাপন করে সিম্ফনি। বর্তমানে মাসে প্রায় পাঁচ লাখ ইউনিট ফোন উৎপাদন করছে কোম্পানিটি। সিম্ফনি, ওয়ালটন ছাড়াও দেশে কারখানা স্থাপন করে বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ট্রানশন হোল্ডিংসের হ্যান্ডসেট দেশে অ্যাসেম্বল করছে টেকনো।

২০১৮ সালে বাংলাদেশে অ্যাসেম্বলিং কারখানা তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল হ্যান্ডসেট কোম্পানি স্যামসাং। নরসিংদীতে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্সের এ কারখানায় কর্মসংস্থান ২ হাজারের বেশি লোকের। প্রতি বছর ৬০ লাখ ইউনিট অ্যাসেম্বলিং সক্ষমতার লক্ষ্য নিয়ে স্যামসাং তাদের কারখানায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করেছে।

আর ভিভো নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলায় ২০১৯ সালে তাদের নতুন ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্টের উদ্বোধন করেছে। এটি ছিল তাদের পঞ্চম বৈশ্বিক উৎপাদন কারখানা। রূপগঞ্জের প্ল্যান্টটির প্রতি বছর অন্তত ১০ লাখ স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার সক্ষমতা রয়েছে।

একই বছর গ্লোবাল স্মার্টফোন ব্র্যান্ড অপ্পো গাজীপুরে বেনলি ইলেকট্রনিক এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি লিমিটেড নামে তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং প্ল্যান্ট চালু করে। সেখানে বছরে ১০ লাখ ইউনিট স্মার্টফোন অ্যাসেম্বল করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে অপ্পো। এছাড়াও গত তিন বছরে দেশে কারখানা স্থাপন করেছে শাওমি, নোকিয়া, লাভাসহ অন্তত সাতটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড।

সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রথম স্থানীয় অ্যাসেম্বলারদের জন্য একটি ট্যাক্স পলিসি চালু করে। এরপর থেকে প্রতি বাজেটেই এটি সংশোধন করা হয়েছে। বর্তমানে স্মার্টফোন আমদানিতে ৫৭ শতাংশ এবং বেসিক ও ফিচার ফোনে ৩২ শতাংশ ট্যাক্স রয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ও অ্যাসেম্বলড হ্যান্ডসেটের জন্য ট্যাক্স যথাক্রমে ১৩ ও ১৮ শতাংশ।

আরএম/আরএইচ