রাজধানীর অভিজাত হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার সম্পূরক শুল্কসহ ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রায় ছয় বছরে পানশালা (মদের বার) ও ড্যান্স ফ্লোরের বিভিন্ন সেবায় প্রযোজ্য ওই শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধে পাঁচ তারকা হোটেল কর্তৃপক্ষকে ১৫ কর্মদিবস সময় দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বৃহৎ করদাতা ইউনিটের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বিভাগ।

যদিও অপরিশোধিত বা বকেয়া রাজস্ব আদায়ে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বিভাগকে আদালত পর্যন্ত যেতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আদালতের চূড়ান্ত রায়ে বিষয়টির মীমাংসা হয় এবং ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়ার আদেশ জারি হয়।

প্রায় ছয় বছরে পানশালা (মদের বার) ও ড্যান্স ফ্লোরের বিভিন্ন সেবায় প্রযোজ্য ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধে পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও কর্তৃপক্ষকে ১৫ কর্মদিবস সময় দিয়েছে এনবিআর

ভ্যাট ফাঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে হোটেল সোনারগাঁওয়ের অডিট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সরকারের কিছু সাংঘর্ষিক আইন রয়েছে। ওই আইন নিয়েই এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। যে কারণে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। শুধু আমাদের হোটেল নয়, বাংলাদেশের অনেক অভিজাত হোটেল একই ধরনের সমস্যা নিয়ে আদালতে গিয়েছিল সুরাহা পাওয়ার জন্য। যদিও আদালতের রায় আমাদের বিপক্ষে গেছে। কোর্ট আমাদের আপিল ডিসমিশড (খারিজ) করেছে।

২০ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার সম্পূরক শুল্কসহ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও / ফাইল ছবি

‘এখন আদালত যে রায় দিয়েছেন, সেটা মেনে নিতে হবে। এর বাইরে আমার বলার কিছু নেই।’

অন্যদিকে, এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজধানীর অভিজাত শ্রেণির মাস্তি ও বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বিলাসবহুল হোটেলগুলো। এর মধ্যে অন্যতম পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁও। অভিজাত হোটেলটির রয়েছে আলাদা পানশালা (মদের বার) ও ড্যান্স ফ্লোর। বিলাসী এ পানশালা ও ড্যান্স ফ্লোরের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্কসহ ভ্যাট প্রযোজ্য ছিল। গত ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত শুল্কবাবদ ভ্যাট পরিশোধ করেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ। বৃহৎ করদাতা ইউনিটের ভ্যাট বিভাগ রাজস্ব ফাঁকির এ তথ্য উদঘাটন করে।

“অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পানশালা ও ড্যান্স ফ্লোরে মদসহ বিভিন্ন সেবাবাবদ হোটেল সোনারগাঁও ২০ কোটি ৭৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা শুল্কসহ ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। বিপুল অংকের রাজস্ব আদায়ে দাবিনামা জারি করলেও দিতে অস্বীকৃতি জানায় হোটেল কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় বকেয়া রাজস্ব আদায়ে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে সরকারের পক্ষে মামলা করে এলটিইউ ভ্যাট বিভাগ। মামলার রায় সরকারের পক্ষে আসায় হোটেল কর্তৃপক্ষ উচ্চ আদালতে রিট করে। ২০১৭ সালের ১২ জুলাই আপিল বিভাগ একই রায় দেন। রায়ে শুল্কসহ ভাট ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণিত হয়। কিন্তু মামলার চূড়ান্ত রায়ের পরও হোটেলটি রাজস্ব পরিশোধ না করে আপিল করে। সেখানেও তারা হেরে যায়। পরে অপরিশোধিত রাজস্ব আদায়ে চিঠি দেওয়া হয়।”

ঢাকার ঐতিহাসিক পাঁচ তারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও / ফাইল ছবি

গত ১৮ মে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের ভ্যাট বিভাগের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সই করা পৃথক দুই চিঠিতে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে শুল্কসহ ভ্যাটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে ট্রেজারি চালানের মূল কপি এলটিইউ-এর অফিসে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়।

প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবর দেওয়া প্রথম চিঠিতে বলা হয়, সোনারগাঁও হোটেল কর্তৃপক্ষের দায়েরকৃত রিট পিটিশন ও সিভিল রিভিউ পিটিশন (রিট পিটিশন নং- ৫৪৩০/২০০৯ , সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৫৩৭/২০১৭) মামলার রায় সরকারের পক্ষে প্রচারিত হয়েছে। যা সেনা হোটেল ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামীয় প্রতিষ্ঠানের সিভিল রিভিউ পিটিশন (পিটিশন নং- ৪৯৮/২০১৭) মামলার সাথে একত্রে সোনারগাঁও হোটেলের সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশনে দায়েরকৃত সিভিল রিভিউ পিটিশনের রায়ে মামলাটি ডিসমিশড হয়েছে। সুতরাং আদালতের প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী ২০০৫ সালের জুলাই থেকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়কালের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্কসহ মুসক বাবদ ১০ কোটি ৩৬ হাজার ১৮৪ টাকা বর্তমানে নিরঙ্কুশ বকেয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অতএব, উক্ত সরকারি বকেয়া পাওনা আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূল কপি এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের মূল্য সংযোজন কর বিভাগে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো।

গত ১৮ মে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের ভ্যাট বিভাগের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সই করা পৃথক দুই চিঠিতে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে শুল্কসহ ভ্যাটের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানানো হয়েছে

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রধান কার্যালয় / ফাইল ছবি

একই প্রতিষ্ঠানের এমডি বরাবর অপর এক চিঠিতে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের ফাঁকি দেওয়া ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সম্পূরক শুল্কসহ মূসকবাবদ ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ টাকা অপরিশোধিত বা বকেয়া রয়েছে। অপরিশোধিত ওই টাকা সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে এলটিইউ-এর দাবিনামা চ্যালেঞ্জ করে ২০১১ সালে হোটেল কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট দায়ের করে (রিট পিটিশন নং- ৮০৫১/২০১১)। ওই আদেশ সরকারের পক্ষে গেলে সোনারগাঁও হোটেল থেকে ২০১৭ সালে রিভিউ পিটিশন (সিভিল রিভিউ পিটিশন নং- ৫৩৮/১৭) করা হলে তার রায়ও সরকারের পক্ষে প্রচারিত হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ডিভিশন মামলাটি ডিসমিশড হিসেবে রায় প্রদান করেন। ফলে আদালতের প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী ওই দুই বছরের অপরিশোধিত সম্পূরক শুল্কসহ মূসক ১০ কোটি ৭৪ লাখ ৫৬ হাজার ১৬ টাকা বর্তমানে নিরঙ্কুশ বকেয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাই বকেয়া পাওনা আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে জমাদানপূর্বক ট্রেজারি চালানের মূলকপি এলটিইউ-এর ভ্যাট বিভাগে দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হলো।

এ বিষয়ে জানতে এলটিইউ-এর ভ্যাট বিভাগের কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ঢাকার একটি ঐতিহাসিক পাঁচ তারকা হোটেল। ১৯৮১ সালের প্রতিষ্ঠিত দেশের অন্যতম প্রাচীন এ হোটেলের মালিক বাংলাদেশ সরকার। তবে হোটেলটি পরিচালনা করে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান প্যান প্যাসিফিক হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস। রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় আট একর জমির ওপর হোটেলটি অবস্থিত।

আরএম/এমএআর