নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মাছ-মাংস না খেয়েও চার সদস্যের একটি পরিবারের মাসিক ব্যয় হয় ২৯ হাজার ২০৬ টাকা। রাজধানীতে এক কক্ষে বসবাসরত এ ধরনের পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যয় হচ্ছে ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা।

রোববার (৫ জুন) বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডির) গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশের উন্নয়নে স্বাধীন পর্যালোচনা শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে সব পণ্যমূল্য বৃদ্ধির এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। এতে বাংলাদেশেও প্রায় পণ্যেরই দাম বেড়ে গেছে। রাজধানীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার চার সদস্যদের পরিবারের সদস্য যারা একটি বেডরুমের বাসায় থাকেন, কোনো ধরনের মাছ ও মাংস না খেয়েই তাদের মাসে খরচ করতে হচ্ছে ২৯ হাজার ২০৬ টাকা। এ ধরনের পরিবারের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ব্যয় হচ্ছে ৪২ হাজার ৫৪৮ টাকা।

তিনি বলেন, শ্রমিক পর্যায়ে চার সদস্যের একটি পরিবারের খরচ হয় ২১ হাজার ৩৫৮ টাকা। পরিবারটি যদি মাছ-মাংস না খেয়ে খরচ কমাতে চায়, এরপরও বাসাভাড়াসহ ন্যূনতম ব্যয় হচ্ছে ৮ হাজার ১৬ টাকা। আমাদের দেশে মিনিমাম মজুরি দিয়েও একজন শ্রমিক জীবন-ধারণ করতে পারছেন না। বেশিরভাগই রেগুলার ডায়েট পাচ্ছেন না। মজুরি ৫ শতাংশ বাড়ানো হলেও তারা পারছেন না। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছি আমরা। কৃষি শ্রমিক, মৎস্যচাষী, বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি সরবরাহকারী, মোটরসাইকেল ও পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ, আবাসন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের বিবেচনা করে এ হিসাব করা হয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সালে ৫০ কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। মুদ্রাস্ফীতির চাপে তাদের সমস্যা হচ্ছে না। ধনী ও গরিবের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। সেজন্য এখনই সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন ফাহমিদা।

এক প্রশ্নের উত্তরে সিপিডি বলেছে, এ হিসাব তাদের প্রাক্কলন। বিবিএস, টিসিবি ও বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। তবে সঠিকভাবে জরিপ করলে এর প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ঢাকার বাইরে তিন কক্ষে বসবাসকারী পরিবারের মাসিক ব্যয় ৫৬ হাজার ৪৬৯ টাকা। ঢাকার মধ্যে তিন কক্ষে বসবাসকারী পরিবারের ব্যয় হচ্ছে ৭০ হাজার ৩৬৯ টাকা। তবে ছাড় দিয়ে চললে ঢাকার বাইরেও ৪৩ হাজার ১২৭ টাকা ব্যয় করে চলতে হচ্ছে একটি পরিবারকে।

এভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সব শিল্প কারখানার শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি পুনর্গঠন ও সংশোধন করা দরকার। একইসঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সরবরাহও বাড়াতে হবে। কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতির যে অবস্থা, তাতে চারজনের সব খাবার খেয়ে চলা সম্ভব নয়।

ফাহমিদা খাতুন তার প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েই যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারও বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চরমভাবে চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। রাজস্ব আদায়ও কম হচ্ছে। তাই বাস্তবভিত্তিক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি দরকার। যে খাতে ভর্তুকি দরকার, অবশ্যই দিতে হবে। সরকারি ব্যয়ও (এডিপি বাস্তবায়ন) বাড়াতে হবে। চলমান সংকট মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় অবশ্যই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। একই সময় সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। করোনায় কৃষি ভরসা জায়গা করে নিলেও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে অবদান কমে যাচ্ছে। তবে শিল্পখাতের মধ্যে বড় শিল্পকারখানার অবদান বাড়ছে।

তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ জিডিপির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই জিডিপির হিসাব বাস্তবভিত্তিক হওয়া দরকার। তাহলেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। তবে দেশে কীভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা দেখার বিষয়। কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে অবশ্যই সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানসম্মত নির্ভুল তথ্যের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ দেখা যায়, রাজস্ব আদায়সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এনবিআর একরকম তথ্য দেয়, অর্থ মন্ত্রণালয় আরেক রকম। বেশি লক্ষ্য ধরে আদায় হয় না। আবার আদায় হলেও রাজস্ব ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এবারও ৩০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। এর ফলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও প্রভাব পড়ে, গতি বাড়ে না। বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ, ভর্তুকি, অভ্যন্তরীণ ঋণ ও ঋণের সুদের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

আরএম/আরএইচ