‘২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চ্যালেঞ্জগুলোকে স্বীকার করা হয়েছে, যা প্রশংসনীয়। তবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় যে পদক্ষেপগুলো গ্রহণ জরুরি, সেখানে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনার অভাব বিদ্যমান।’ 

বিশেষত, মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত যে সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা সমাধানের লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির শুল্ক কমানো এবং যোগান বৃদ্ধি করার জন্য প্রথাগত আমদানির বিকল্প উৎস খতিয়ে দেখার মতো বিভিন্ন উদ্যোগ বাজেট ঘোষণায় অনুপস্থিত ছিল। বাজেটে যদিও মূল্যস্ফীতির সমাধানে মজুতদারির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তবে বাজার ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব দেশে অনেকদিন ধরেই বিরাজমান।

প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) পক্ষ থেকে এসব কথা জানানো হয়।

এর আগে বৃহস্পতিবার (৯ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

প্রতিক্রিয়ায় সানেম জানায়, বাজেটে বেশকিছু প্রশংসনীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য উল্লিখিত আছে। যেগুলো আমরা বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বা অন্যান্য সরকারি পরিকল্পনায়ও দেখেছি। কিন্তু তার বাস্তবায়নের জন্য সুষ্পষ্ট কর্মপরিকল্পনার অভাব যথারীতি এই বাজেটেও বিরাজমান। যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বৃদ্ধি, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বা কারিগরি শিক্ষা সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে, বাস্তবায়নের রূপরেখার অভাব বাজেটে পরিলক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নে যে সক্ষমতার অভাব বিদ্যমান, তার সমাধানকল্পে দিকনের্দেশনার অভাব বাজেটে পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষত, শিক্ষার ক্ষেত্রে, অতিমারি পরবর্তী শিখন ক্ষতি মোকাবিলায় সুষ্পষ্ট দিকনির্দেশনার অভাব রয়েছে। সম্পূরক বাজেটের পর্যালোচনায় প্রতীয়মান যে বাজেট বাস্তবায়নের জায়গায় যে সক্ষমতার অভাব আমাদের দীর্ঘকালীন একটি সমস্যা, সেখানে আমরা এখনো আশানুরূপ অগ্রগতি অর্জন করতে পারিনি।

বিনিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো, যেমন পিপিপি সংক্রান্ত আলোচনা বাজেটে যথাযথভাবে উঠে আসেনি, বরং গতানুগতিকভাবে বিবৃত হয়েছে।

বাজেটে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় দেওয়া পদক্ষেপগুলোর অধিকাংশই বাস্তবে প্রশ্নসাপেক্ষ অবস্থায় রয়েছে। যেমন টিসিবির মাধ্যমে বা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পৌঁছানোর যে উদ্যোগ, তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলেই মনে হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান, তার আলোচনার অভাব রয়েছে বাজেট ডকুমেন্টে।

একদিকে, চাহিদার প্রবৃদ্ধি কমানোর পদক্ষেপ সংক্রান্ত বক্তব্য স্পষ্ট নয়। প্রথমত, বর্তমান মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত সংকটের কারণ চাহিদা বৃদ্ধিজনিত নয় বরং যোগানের সরবরাহের সংকট; দ্বিতীয়ত, এ ধরনের পদক্ষেপ অর্থনীতিকে সংকুচিত করবে, যা অতিমারি থেকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বাধার সৃষ্টি করবে। আগামী বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ রাখার কথা বলা হয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা উচ্চাভিলাষী বলে মনে হয়েছে।

অতিমারি থেকে পুনরুদ্ধারের যে দাবি বাজেটে করা হয়েছে, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। বিশেষত, সামাজিক পুনরুদ্ধারের গতি দুর্বল, যা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। এমনকি দারিদ্র্য হারেরও হাল-নাগাদ করা তথ্যের অভাব বিদ্যমান রয়েছে বাজেটে। পাশাপাশি, বর্তমান প্রেক্ষাপট অতিমারি থেকে পুনরুদ্ধারকে কীভাবে প্রভাবিত করছে সেই সংক্রান্ত আলোচনার অভাব বাজেটে লক্ষ্যণীয়। বাজেটে উল্লেখিত ছয়টি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়ের তালিকায় দারিদ্র্য এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত আলোচনার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে।

বাজেট ঘোষণায় জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অ্যাকশন প্ল্যান ২০১৫ বাস্তবায়ন করার কথা বলা হলেও এখনো এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য একটি সম্পূর্ণ তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে যে অসামাঞ্জস্যতা রয়েছে, প্রকৃত গ্রহীতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা রয়েছে তা কীভাবে দূর করা হবে বাজেট ঘোষণায় তা অনুপস্থিত ছিল।

প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলা হলেও গতানুগতিকতার বাইরে বড় ধরনের কোন সংস্কারের কথা বাজেট ঘোষণায় পরিলক্ষিত হয়নি। আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে যে সংস্কারগুলোর প্রয়োজন ছিল, তাও প্রস্তাবিত বাজেটে পাওয়া যায়নি।

সুদের হার যৌক্তিকীকরণের কথা বলা হলেও ব্যাংক খাতে সুদের হারের নয়-ছয় শতাংশের যে নির্ধারিত সীমা রয়েছে, তার ফলে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশের বেশি হলে আমানতের প্রকৃত সুদের হার যে ঋণাত্নক হতে পারে সে বিষয়ে বাজেটে কোনো দিকনির্দেশনা চোখে পড়েনি।

বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে কর ছাড় দেওয়ার যে প্রবণতা, বাজেট ঘোষণায় তা পরিহার করার কথা বলা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য বাড়ানোর জন্য পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেও যে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেটি সময়োপযোগী।

এসআই/এসএম