হঠাৎ নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কারণে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের চলমান কাজের মূল্য সমন্বয় ও নতুন রেট সিডিউলের দাবি করেছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদ।

রোববার (২৬ জুন) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় এ দাবি করে সংগঠনটি।

সভায় ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসেবে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের ঠিকাদাররা সাফল্যের সঙ্গে বাস্তবায়ন করে আসছে। কিন্তু গত এক বছরের অধিক সময় ধরে নির্মাণ প্রকল্পের মূল উপকরণগুলো যেমন- লৌহ ও লৌহজাতীয় দ্রব্য, সিমেন্ট, পাথর, ইট, বিটুমিন, ডিজেল, অ্যালুমিনিয়াম, বিল্ডিং ফিনিশিং আইটেমসহ এ খাতের প্রায় সব ধরনের নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অস্বাভাবিক ও লাগামহীনভাবে বেড়ে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

তারা জানায়, বর্তমানে প্রতিটন রডের বর্তমান মূল্য ৯০ হাজার টাকা থেকে ৯৫ হাজার টাকা হয়েছে যা ২০২১ সালের মার্চে ছিল ৫৫-৬০ হাজার টাকা। অর্থাৎ শতকরা বৃদ্ধির হার ৬০ শতাংশের অধিক। পানি সরবরাহ, পয়নিষ্কাশন, বৈদ্যুতিক সামগ্রী, ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল দ্রব্যের মূল্যও ৪০-৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিক, সুপারভাইজার ও দক্ষ জনবলের মজুরিও শতকরা ৬০-৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানি তেল বিশেষ করে ডিজেলের মূল্য ৬৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০ টাকা হওয়ার ফলে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন ও যন্ত্রপাতি চালন ব্যয় বেড়েছে। 

পাশাপাশি চলমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমদানি করা সকল নির্মাণ মালামালের ও যন্ত্রপাতির মূল্যও ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এছাড়া নির্মাণ প্রকল্পে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ বিল চুক্তি সন্নিবেশিত না থাকায় ঠিকাদারকে তা পরিশোধ করতে হয়। গত অর্থবছরে দরপত্র দাখিলের সময় ৫ শতাংশ হারে এআইটি ধার্য ছিল এখন তা ৭ শতাংশ করা হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পের অগ্রগতিতে অতি মন্থরতা দেখা দিয়েছে, বাস্তব অগ্রগতি খুবই হাতাশাব্যঞ্জক। কাজের স্বাভাবিক অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ার ফলে ঠিকাদাররা বিল পাচ্ছেন না। ফলে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে ব্যাংক থেকে নতুন আর্থিক সহায়তা অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে। এতে করে ঠিকাদাররা আর্থিক সক্ষমতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নির্মাণ সামগ্রীর সীমাহীন ঊর্ধ্বগতিতে ঠিকাদাররা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

ঠিকাদার নেতারা বলেন, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নকারী নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহ সব সময় চলমান বাজারদরের ওপর ভিত্তি করে দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণ করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক দরে কার্যাদেশ প্রাপ্ত হন। সাধারণত জিওবি ফান্ডের সব কাজ ফিক্স রেটে দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার পরে কাজ সমাপ্তির আগে নির্মাণ সামগ্রিক মূল্য বাড়ায় সরকার থেকে কোনো মূল্য সমন্বয় পাইনি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, জিওবির প্রকল্পে ১৮ মাসের অধিক কার্যকালীন সময়ের দরপত্রে মূল্য সমন্বয়ের বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হয় না। নির্মাণ সামগ্রীর বাজার দর বহুবার বৃদ্ধি পেলেও রেট সিডিউল হালনাগাদ করা হয়নি। বর্তমানে দেশের সড়ক, মহাসড়ক, ব্রিজ, কালভার্ট, বিভিন্ন সুউচ্চ ভবন ইত্যাদির কাজ প্রায় বন্ধ। ঠিকাদাররা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছেন। সে কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এমন অবস্থায় ঠিকাদারদের রক্ষায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত সিপিটিইউয়ের কাছে বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদ কয়েকটি দাবি জানিয়েছে।

এগুলো হলো- চলমান কাজগুলো যেহেতু ফিক্সড রেট কন্ট্রাকে সম্পাদিত হচ্ছে তাই বিশেষ ব্যবস্থায় প্রজ্ঞাপন জারি করে পিপিআরে সন্নিবেশিত ফর্মুলা অনুযায়ী মূল্য সমন্বয় ধারা প্রয়োগ করে চলমান চুক্তিবদ্ধ কাজের দর সমন্বয় করা। প্রকল্পের কাজে ব্যবহৃত পানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত খরচ সমন্বয় করা। বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে নির্মাণ সামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির বিপরীতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিটি নির্মাণ কাজের প্রাক্কলনে আওতায় প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা, আমদানি নির্ভর নির্মাণ সামগ্রীর কাঁচামালের আমদানি শুল্ক সাময়িকভাবে হলেও স্থগিত করা। এছাড়া মূল্য সংশোধন সেল গঠন করে চুক্তিবদ্ধ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ ও নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা।

ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের দাবিগুলোর একটি কপি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে দেওয়া হয়। এ সময় তিনি দাবিগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেন।

সভায় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ঠিকাদার ঐক্য পরিষদের সভাপতি রফিক আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক ম. আব্দুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বাসি) ডিরেক্টর হাসান মাহমুদ বাবু, ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. বশির আহমেদ, সম্রাট এন্টারপ্রাইজের মোয়াজ্জেম হোসেনসহ দেশের বিভিন্ন ঠিকাদারি কোম্পানির স্বত্বাধিকারী ও মনোনীত প্রতিনিধিরা।

এসআই/ওএফ