বড় ঘাটতি থেকে বের হতে পারছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের ১১ মাস (জুলাই-মে) শেষেও ৩৬ হাজার ৩১০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার রাজস্ব ঘাটতির মুখোমুখি সরকারি এ সংস্থাটি।

এনবিআরকে যদি তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হয়, তাহলে জুন মাসেই ৭৯ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করতে হবে; যা অসম্ভব। আগামীকাল থেকে নতুন অর্থবছর শুরু হবে। এ সময়ের মধ্যে ৭৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা কঠিন বলে মনে করছেন খোদ এনবিআর কর্মকর্তারাই। 

চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত এনবিআরের তিন বিভাগ; আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বিভাগে নির্ধারিত ২ লাখ ৮৬ হাজার ৯১৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৬০৫ কোটি ২০ লাখ টাকা। রাজস্ব আদায়ে ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৭ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এনবিআরের পরিসংখ্যান ও গবেষণা বিভাগের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আমদানি বৃদ্ধির প্রভাব পাওয়া গেছে আমদানি-রপ্তানি খাতে। ১১ মাসে এই খাতে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮০ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তারপরও এই খাতে ৬ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।

অন্যদিকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নসহ নানা কার্যকরী উদ্যোগেও কাঙ্ক্ষিত সুফল মেলেনি ভ্যাট বিভাগে। চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১১ মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। আর এটাই সর্বোচ্চ রাজস্ব ঘাটতি।

আর আয়কর ও ভ্রমণ খাতে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা। এই খাতে ৮৫ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৭ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এ বিষয়ে এনবিআর পরিসংখ্যান বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে নাম প্রকাশ না করে এ বিষয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত এনবিআরের তিন বিভাগে লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৮৭.৩৪ শতাংশ লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। যার মধ্যে কাস্টমস বিভাগ থেকে ৯২.৩৫ শতাংশ, আয়করে ৯০.০৩ শতাংশ এবং ভ্যাট বিভাগ থেকে ৮১.৪৯ শতাংশ রাজস্ব আহরণ সম্ভব হয়েছে। এটা কম সাফল্য নয়! তবে বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে আরও বড় লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। জানি না এমন পরিস্থিতিতে কতটুকু এগিয়ে যাবে। তবে আমাদের প্রচেষ্টার কমতি নেই।

চলতি অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৯২ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১১ মাসে ভ্যাট আদায়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। আর এটাই সর্বোচ্চ রাজস্ব ঘাটতি।

এ বিষয়ে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের রাজস্ব আহরণের সরাসরি সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কারণ এই পরিস্থিতিতে আমদানি ব্যয় বাড়লে আমদানি শুল্ক বাড়বে। আমি এভাবে দেখতে চাই। জনগণের ক্রয়ক্ষমতা যদি ঠিক রাখা যায়, তাহলে ভ্যাট আদায়ও বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। আর একটি বিষয় হচ্ছে রপ্তানি। বৈশ্বিক কারণে এই সেক্টরে প্রভাব পড়তে পারে। তবে এর সঙ্গে সরাসরি রাজস্ব আদায়ের সম্পর্ক নেই।

তিনি বলেন, দেশের ভেতরে রাজস্ব আদায়ের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যেমন; করের আওতা বৃদ্ধি করা, কর বৈষম্য ও কর ফাঁকি দূর করা ইত্যাদি। যেটা এনবিআর তথা সরকার পরছে কি না সেটাই বড় প্রশ্ন; কর আদায়ের সক্ষমতা যদি বৃদ্ধি করা যায়, তাহলে বলব এনবিআরের এমন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। আগামী অর্থবছরেও ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রাও কঠিন কিছু নয়।

কর ফাঁকিবাজদের জামাই আদর করলে হবে না মন্তব্য করে এনবিআরের সাবেক এ কর্তা আরও বলেন, সরকারকে এনবিআরের রাজস্ব আহরণে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে পঙ্গু রেখে রাজস্ব আদায় কীভাবে বাড়বে? আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কিন্তু কর জিডিপির কেন উন্নতি হচ্ছে না? তার মানে আমার ভেতরেই ক্ষত রয়েছে। হয় আপনি জিডিপির ভুল তথ্য দিচ্ছেন, না হয় কর ফাঁকিবাজদের ছেড়ে দিচ্ছেন। কর ফাঁকিবাজদের জামাই আদর করলে হবে না। এতে প্রকৃত করদাতা নিরুৎসাহিত হয়। কেন কর জিডিপি অনুপাত বাড়বে না? আমি মনে করি এনবিআরকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকেই এই সব জায়গায় শক্ত হতে হবে।

করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আমদানি বৃদ্ধির প্রভাব পাওয়া গেছে আমদানি-রপ্তানি খাতে। ১১ মাসে এই খাতে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৮০ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৭ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। তারপরও এই খাতে ৬ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।

এর আগে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এনবিআর আদায় করেছিল ২ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। অবশ্য ঘাটতি বাড়লেও ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটে লক্ষ্য সবচেয়ে বেশি। এ খাতে লক্ষ্য ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। আয়কর ও ভ্রমণ করে লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৫ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা। আমদানি শুল্কে লক্ষ্যমাত্রা ৯৫ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা।

আরএম/এসকেডি