সরকারের স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে পাঁচ বছরে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বাবদ প্রায় ৪৬৮ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। বকেয়া সেই পাওনা পরিশোধ না করে দাবি প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

এনবিআর নির্দেশনা বহির্ভূত সময়কালের ওই ভ্যাট আদায় না হওয়াসহ বেশ কিছু কারণ দেখিয়ে দাবি প্রত্যাহারের পাশাপাশি পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) ও যুগ্ম সচিব মো. জাফর আলম সই করা চিঠির সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। গত ২১ জুলাই চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট বরাবর চিঠিটি পাঠানো হয়েছে বলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে- এনবিআর যে সময়ের ভ্যাটের কথা বলছে, সে সময়ে ভ্যাট বিভাগের কোনো নির্দশনা ছিল না। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেবাগ্রহীদের কাছ থেকে কোনো ভ্যাট সংগ্রহ করেনি। তাই ভ্যাট বিভাগ যে ভ্যাট দাবি করছে তা অযৌক্তিক। 

আরও পড়ুন : সরকারি এক সংস্থাই ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে ৪৬৮ কোটি টাকা

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম ভ্যাট অফিস থেকে যে ভ্যাট দাবি করা হয়েছে, সেটা এখনও বকেয়া রয়েছে। যখন থেকে এনবিআরের ভ্যাট সংগ্রহের আদেশ জারি করা হয়েছে, তারপর থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করেছি এবং সরকারি কোষাগারে জমাও দেওয়া হয়েছে। আদেশের আগে ভ্যাট সংগ্রহের প্রশ্ন ছিল না।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ভ্যাট কমিশনার সাহেবও আমাদের অফিসে এসেছিলেন। আমাদের চেয়ারম্যানসহ মিটিং করেছি। সেখানে আমরা বলেছি, আদেশের আগে যেহেতু সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়া হয়নি, তাই জমা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অফিস আদেশের পর থেকে নিয়মিত ভ্যাট পরিশোধ করা হচ্ছে।

সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে ওমর ফারুক বলেন, আমাদের অবস্থান পরিষ্কার। এ বিষয়ে আমরা তাদের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছি। এখন সরকারি পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত আসবে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব। 

গত ১৪ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো চিঠিতে বকেয়া ভ্যাট ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে পরিশোধের অনুরোধ করে এনবিআর। 

এর কিছুদিন পর বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর (বিআইএন) লক করে বকেয়া ভ্যাট আদায় করার কথা উল্লেখ আবারও চিঠি দেয় ভ্যাট অফিস।  

• আরও পড়ুন : রেমিট্যান্স-মর্টগেজ ঋণ নাটকেও রেলওয়ে কমান্ড্যান্টের রক্ষা হয়নি

এরই পরিপ্রেক্ষিতে দাবি প্রত্যাহারের চিঠি দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন সেবার বিপরীতে কোনো ভ্যাট অন্তর্ভুক্তি ছাড়াই ৬০টি ট্যারিফ আইটেম প্রচলন করা হয়েছিল। এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী ১৯৯১ সাল থেকে মাশুলের ওপর পণ্যাগার হিসেবে এবং পরবর্তীতে একইরূপ বর্ণনাপূর্বক ২০০৮ সালে ‘বন্দর’ হিসেবে ভ্যাট আরোপ করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে প্রচলিত ট্যারিফের ৬০টি আইটেমের মধ্যে দুই ধাপে অর্থাৎ ১ম পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে ২১টি ও ২য় পর্যায়ে ২০০৪ সালে  ৪টি আইটেমসহ মোট ২৫টি আইটেমের ওপর ভ্যাট আদায়ের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। সেই  নির্দেশনা অনুসরণ করে চট্টগ্রাম বন্দর সরকারি কোষাগারে মূসক পরিশোধ অব্যাহত রাখে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২৭ ডিসেম্বরের নির্দেশনা দেওয়ার পর সকল আইটেমের ওপর ভ্যাট আদায় করা হয়। ভ্যাট প্রবর্তিত হওয়ার পর সেবা গ্রহণকারী অর্থাৎ বন্দর ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করে সরকারি কোষাগারে যথারীতি জমা করা হয়েছে। ওই সময়ে ভ্যাট কর্তৃপক্ষ কোনো অভিযোগ উত্থাপিত করেনি। অথচ সম্প্রতি এক চিঠিতে বন্দর কর্তৃপক্ষের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও বিআইএন লক করার কথা বলা হয়েছে।
দেশের আমদানি-রপ্তানির শতকরা ৯২ ভাগ যে বন্দরের মাধ্যমে সম্পাদিত হয়, সে সংস্থার ক্ষেত্রে এরূপ বক্তব্য অনভিপ্রেত বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, এনবিআরের দাবিকৃত বকেয়া ভ্যাট বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আদায়কৃত সেবা মূল্যের ওপর নিরূপিত নয়, বিধায় ওই দাবি যথাযথ নয়। কারণ, শতভাগ রপ্তানিমুখি অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান এনবিআর থেকে ট্যারিফ আইটেমের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি পেয়ে থাকে। ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বিবেচনায় না নিয়ে ২০১৫-২০১৬ থেকে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের ট্যারিফ আইটেমগুলোকে ভিত্তি ধরে আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট হিসেবে দাবি করা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের কাছে প্রায় ৬০ কোটি, চিটাগং ড্রাইডক লিমিটেডের কাছে ১০ কোটি ও লোকাল ভেসেল বিল বাবদ প্রায় ১৪ কোটি টাকা অনাদায়ী রয়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন শিপিং এজেন্টের জরিমানা ও কোটি কোটি টাকা বন্দর মাশুল অনাদায়ী রয়েছে। যা ভ্যাট কর্তৃপক্ষের বকেয়া ভ্যাট দাবিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই এভাবে একতরফাভাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আদায়কৃত সেবা মূল্যকে বিবেচনা না করে অনাদায়ী আয়ের ওপর ভিত্তি করে ভ্যাট হিসাব করা অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন ।

ভ্যাট আদায়ের জন্য সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরকে সর্বোচ্চ ভ্যাট প্রদানের সম্মাননা স্মারকের কথা উল্লেখ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, কোভিড-১৯ মহামারিকালেও চট্টগ্রাম বন্দর সচল রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানসহ আয়কর ও ভ্যাট আদায়ে সচেষ্ট ছিল এনবিআর। সীমিত জনবল দিয়ে ভ্যাট আদায়ের মতো জটিল কার্যক্রম ইতিবাচক হিসেবে দেখার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ এনবিআরের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে। 

চিঠির বিষয় এনবিআর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।  

• আরও পড়ু : বাংলাদেশি পাসপোর্টে আরবে ভারতীয় নাগরিক, ফাঁসলেন ৭ কর্তা

তবে এনবিআর সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরে ৬৯ ধরনের সেবা গ্রহণ করা হয়, যার বিপরীতে ৫, ৯ ও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে এ বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট আদায় হয়, তা সঠিকভাবে পরিশোধ করা হয় না বলে অভিযোগ পায় এনবিআর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআরের নির্দেশে ২০১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর একটি নিরীক্ষা দল গঠন করে মূসক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানের সেবা প্রদান, দাখিলপত্র ও ভ্যাটসংক্রান্ত দলিল দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দেওয়া হয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু কাগজপত্র দেয়। পরে চাহিদা মতো আরও কাগজপত্র যেমন- বন্দর কর্তৃপক্ষের বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন, ভ্যাট সংক্রান্ত দলিল, দাখিলপত্র (ভ্যাট রিটার্ন) প্রভৃতি পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন তৈরি করে মূসক গোয়েন্দা।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন, ১৯৯১ ও একই আইনের বিধিমালা অনুযায়ী মূসক নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভ্যাট-সংক্রান্ত দলিলাদি (মূসক চালান-১১, বিক্রয় হিসাব পুস্তক, দাখিলপত্র) সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ সেবা প্রদানের বিপরীতে বিক্রয় হিসাব পুস্তক সংরক্ষণ করেনি, যা মূসক আইনের ধারা ৩১ ও বিধি ২২ লঙ্ঘন।

আরএম/এনএফ