গ্রামীণ টেলিকমসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সব জমি ক্রয়-বিক্রয়ের যাবতীয় হিসাব তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 

রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে সংস্থাটির অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান সই করা চিঠিতে এসব নথিপত্র তলব করা হয়েছে। চাহিদা করা এসব নথিপত্র আগামী ২০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। 

গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও বরাবর পাঠানো চিঠির সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 

চিঠিতে বলা হয়েছে, গ্রামীণ টেলিকমসহ এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন কোন জায়গায় কত মূল্যে কি পরিমাণ জমি ক্রয় করা হয়েছে, যা পরে বিক্রি করা হয়েছে এবং নিজেদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে ক্রয় করা জমিগুলো কীভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট ছকসহ দলিলের সত্যায়িত ফটোকপি।

একইসঙ্গে জমি ক্রয়ের টাকা প্রতিষ্ঠানগুলো কোথা থেকে পেয়েছে ও জমি বিক্রির টাকা কোথায় কীভাবে রক্ষিত আছে। আর লাভ কোথায় কীভাবে খরচ করা হয়েছে তার বিবরণ।

এছাড়া নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে জমি হাতবদল হলে কিসের ভিত্তিতে হয়েছে। এসব জমিতে কোনো ভৌত অবকাঠামো নির্মিত হলে ওই অবকাঠামোর বিস্তারিত খরচের সব হিসাবসহ এ সংক্রান্ত অর্থ কোথা থেকে এসেছে, তার বিস্তারিত তথ্য দিতে বলা হয়েছে।

দুদকের চাহিদা করা নথিপত্রের মধ্যে আরও রয়েছে- সারাবো মৌজায় ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল পার্কে বিভিন্ন সময় মোট ৪৮.৩১ বিঘা জমি ক্রয় করা হয়েছে। এসব জমির ক্রয়মূল্য, অর্থের যোগান, ক্রয় দলিল ও পাওয়ার অব অ্যাটর্নির কাছ থেকে জমি ক্রয়ের রহস্য কি - ব্যাখ্যাসহ যাবতীয় বিবরণ চাওয়া হয়েছে।

চিঠিতে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ লোপাট, শ্রমিক কর্মচারীদের পাওনা পরিশোধের সময় অবৈধভাবে অ্যাডভোকেট ফি ও অন্যান্য ফির নামে ৬ শতাংশ অর্থ কর্তন, শ্রমিক কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিলে বরাদ্দ করা সুদসহ ৪৫ কোটি ৫২ লাখ ১৩ হাজার ৬৪৩ টাকা বিতরণ না করে আত্মসাৎ ও কোম্পানি থেকে ২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা মানিলন্ডারিংয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে।

এরইমধ্যে গত ৬ সেপ্টেম্বর আদালতের মাধ্যমে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক ইউনিয়নের তিন নেতা ও আইনজীবী ইউসুফ আলীসহ ৮ ব্যক্তির ১৯টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা অবরুদ্ধ বা ফ্রিজ করা হয়। হিসাবগুলোর মধ্যে রয়েছে গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবী ইউসুফ আলী, জাফরুল হাসান শরীফ ও ইউসুফ আলীর ল ফার্মের অ্যাকাউন্ট, শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা কামরুজ্জামান, ফিরোজ মাহমুদ হাসান ও মাইনুল ইসলামের ব্যাংক হিসাব। 

এর আগে শ্রমিক ও গ্রামীণ টেলিকম সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী গ্রামীণ টেলিকমের ১২ বছরের লভ্যাংশ ৪৩৭ কোটি টাকা শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন হওয়ার কথা থাকলেও ২৬ কোটি টাকার হিসাবে গরমিল পাওয়া যায় দুদকের অনুসন্ধানে। শ্রমিকদের টাকা বণ্টন না হয়ে গ্রামীণ টেলিকম এমপ্লোয়ি ইউনিয়ন অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছিল। সেখান থেকে দুই আইনজীবী ও শ্রমিক ইউনিয়নের তিন নেতারা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। যার বড় অংশ যায় আইনজীবী ইউসুফ আলীর পকেটে।

গত ২৫ আগস্ট গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল ইসলাম, আইনজীবী ইউসুফ আলী ও জাফরুল হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। যদিও জিজ্ঞাসাবাদে শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ হয়নি বলে দাবি করেন তারা। 

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন (বি-২১৯৪) সিবিএর সঙ্গে আলোচনা না করেই এক নোটিশে ৯৯ কর্মীকে ছাঁটাই করে গ্রামীণ টেলিকম কর্তৃপক্ষ।

গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আশরাফুল হাসান স্বাক্ষরিত এক নোটিশের মাধ্যমে এ ছাঁটাই করা হয়। এরপর সেই নোটিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন ২৮ জন কর্মী। এই ছাঁটাইকে কেন্দ্র করে ড. ইউনূসকে তলবও করেন হাইকোর্ট। এছাড়া গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চার জনের বিরুদ্ধে মামলাও করে ঢাকার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তর।

চলতি বছরের ২৮ জুলাই গ্রামীণ টেলিকম পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করার কথা জানান সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাপরিদর্শক গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ সংবলিত একটি প্রতিবেদন দুদকে পাঠিয়েছেন। ওই প্রতিবেদন কমিশন পর্যালোচনা করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।

অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের টিম গঠন করে দুদক। টিমে দুদক পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনকে তদারককারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। টিমের অপর সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তার ও নূরে আলম সিদ্দিকী।

গত ১৬ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সংক্রান্ত ১১ ধরনের নথিপত্র সংগ্রহ করে দুদকের অনুসন্ধান টিম। 

আরএম/জেডএস