কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিনির দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে খোলা চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি প্রায় উধাও হয়ে গেছে।

ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ব্যবসায়ীরা খেলায় মেতেছেন। তারা সরকারের কোনো নিয়ম-নীতি মানছে না। নিজেদের ইচ্ছা মতো দাম বাড়াচ্ছে। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সঙ্কটের কারণে তাদের উৎপাদন কমেছে। যার জন্য বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। 

খুচরা দোকানদাররা অবশ্য সেই পুরোনো কথাই বলছেন। বেশি দামে কেনা তাই বিক্রিও করতে হয় বেশি দামে। কোম্পানিগুলো মিলেমিশে দাম বাড়াচ্ছে, আপনারা তাদের কাছে জানতে চান কেন দাম বাড়াচ্ছে।

সরকারি তথ্য মতে, দেশে চিনির মোট চাহিদার বড় একটি অংশ মেটানো হয় আমদানি করা চিনির মাধ্যমে। এই চিনি আমদানি হয় মূলত সিটি, মেঘনা, এস আলম, ইগলু ও দেশবন্ধু গ্রুপের হাত ধরে। এই ব্যবসায়ীরা এখন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের অজুহাতে চিনির দাম বাড়াচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে চিনির সব ধরনের কাঁচামাল রয়েছে কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে চাহিদা অনুসারে চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে উৎপাদন খরচও বাড়ছে। এ কারণে চাহিদার তুলনায় চিনি সরবরাহ কম থাকায় চিনির দাম বাড়ছে।

দাম বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার দর মনিটরিং প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ তথ্য মতে, এক সপ্তাহ আগে চিনির কেজি ছিল ৯০ থেকে ৯৫ টাকা। এখন সেই চিনি কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা ১০০ টাকায়। 

দাম বৃদ্ধির বিষয়ে টিসিবির ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী ও মুখপাত্র হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে চিনির দাম বেড়েছে। তবে টিসিবির চিনির দাম বাড়েনি। তিনি বলেন, কেন দাম বাড়ল তার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আলাদা বিভাগ রয়েছে, তারা বিষয়টি বলতে পারবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর বেশির ভাগ দোকোনে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ কিংবা তিনদিন আগের কেনা চিনি কিছু কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে। তবে এ সময় বাজার ও দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনির দেখাই মেলেনি। এই দোকানগুলোতে এক সপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজিতে। আর প্যাকেটজাত চিনি ছিল ৯৫ টাকা কেজি।

অথচ গত ৬ অক্টোবর সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাতের দাম ৯৫ টাকায় বিক্রির জন্য দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। বরং এখন উল্টো দাম বাড়ছে।

তার আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮৪ টাকা আর প্যাকেটজাত ৮৯ টাকা। নির্ধারিত দামে চিনি সরবরাহ না দেওয়ায় দাম বাড়াতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে চিনি।

মহাখালী ওয়ারল্যাস গেইটের মনির জেনারেল স্টোরের মনির হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সপ্তাহ আগে চিনি কেনা ছিল ৪ হাজার ৭০০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি)। আজকে সেই চিনি কেনাই পড়েছে ৫৩০০ টাকা বস্তা। বস্তায় বেড়েছে ৫০০ টাকা। আমি ১১০ টাকা কেজি বিক্রি করছি।

বাড্ডার ব্যবসায়ী নূরুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, উত্তর বাড্ডা আড়ৎ থেকে মাল এনে এখানে পাইকারি বিক্রি করি। আমি পাইকারি বিক্রি করছি ১০৫ টাকা। আর খুচরা বিক্রি করছি ১১০ টাকা।

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তেল, আটা এবং চিনি সব কিছুর দাম আবার বাড়ছে। জিনিসপত্রের যেভাবে দাম বাড়ছে, কয়েকদিন পর মানুষ ব্যবসায়ীদের পিটিয়ে মারবে।

তিনি অভিযোগ করেন, ১০০ টাকা কেজিতে ৫ বস্তা মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির অর্ডার দিয়েছেন ৫ দিন আগে। এরপর কোম্পানির আর কোনো খবর নেই। দাম বাড়ছে, এখন অর্ডার দিয়ে মাল পাচ্ছি না, আর যখন দাম কমবে জোর করে দিয়ে যায় কোম্পানিগুলো।

জানতে চাইলে মেঘনা গ্রুপের ডিলার দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিতে চিনি নেই, চিনি সংকট এ কারণে আমরা চিনি পাচ্ছি না। তাই দোকানদারদের দিতে পারছি না।

তিনি বলেন, কোম্পানির কাছে জানতে চাইলে কোম্পানি জানিয়েছে, গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমে গেছে। আগের যেখানে দিনে ৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হতো এখন ১ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হচ্ছে। এ কারণে চাহিদা অনুসারে চিনি পাচ্ছি না।

প্রায় একই কথা বলছেন আমিন ব্রাদার্সের ডিলার আমিনুল। তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমেছে। যে চিনি একদিনে দেওয়া যেতো এখন সেই চিনি দিতে ৭ থেকে ৮ দিন সময় লাগে। 

এ বিষয়ে মেঘনা গ্রুপের প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে জানান, কোম্পানিতে চিনির কাঁচামালের কোনো সংকট নেই। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় চিনি উৎপাদন করা যাচ্ছে না।

তিনি জানান, কোম্পানির দিনে ৫ হাজার মেট্রিক টন চিনি পরিশোধনের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু পরিশোধন করছে মাত্র ১ হাজার টন। ফলে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলেই বাজারে দাম স্বাভাবিক হবে বলে জানান তিনি।

এমআই/এনএফ