মেলোনেডস নামের একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিভিন্ন সেবার বিপরীতে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ওই ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিকে দফায় দফায় নোটিশ দেওয়া হলেও ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট সরকার কোষাগারে জমা হয়নি।

ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্তে ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটনের পর বছর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এমনকি বকেয়া ভ্যাট আদায়ে ভ্যাট আইনে মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছে। 

সর্বশেষ অপরিশোধিত ভ্যাট আদায়ে গত ২০ অক্টোবর ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃপক্ষ আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তির জন্য মেলোনেডসের মালিকপক্ষকে শুনানিতে তলব করে। কিন্তু এতেও ভ্যাটের টাকা পরিশোধ হয়নি। মিলেছে শুধু আশ্বাস।

ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর ও ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অডিট আপত্তি উত্থাপিত হওয়ার পর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান সাধারণত ভ্যাট পরিশোধ করে দেয়। কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করারও পর ভ্যাট আদায় হয় না। মেলোনেডস সে রকমই একটি প্রতিষ্ঠান। গত ২০ অক্টোবর তাদের প্রতিনিধি হাজির হলেও অপরিশোধিত ভ্যাট জমা দেয়নি। লিখিত জবাব দেবে জানিয়ে গেছে।

গত ১১ অক্টোবর ঢাকা উত্তর কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ডেপুটি কমিশনার মুনমুন আকতার দিনা সই করা একটি নোটিশ মেলোনেডসকে পাঠানো হয়েছিল। 

মেলোনেডস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মালিক বরাবর পাঠানো নোটিশে বলা হয়, ভ্যাট নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে অপরিশোধিত মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বাবদ তিন কোটি ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং সুদ বাবদ ৩ কোটি ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮২১ টাকাসহ মোট ৬ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ২৬২ টাকার অডিট আপত্তি হয়। এ বিষয়ে ২০২১ সালের ৩০ এপ্রিল প্রথম দফায় নোটিশ দেওয়া হয়। এরপর দফায় দফায় চিঠি চালাচালির পর চলতি বছরের ১ মার্চ ১৯৯১ সালের মূল্য সংযোজন কর আইনের ধারা ৫৫ এর উপ-ধারা (১) অনুযায়ী দাবিনামা সম্বলিত কারণ দর্শানো নোটিশ জারি করা হয়। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে লিখিত জবাব চাওয়া হলেও মেলোনেডস কর্তৃপক্ষ জবাব দেয়নি। সে কারণে ২০ অক্টোবর আবারও শুনানিতে অংশ নিয়ে লিখিতভাবে জানানোর জন্য ওই নোটিশ দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

এর আগে গত বছরের এপ্রিলে ভ্যাট গোয়েন্দার সহকারী পরিচালক মো. মাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল মেলোনেডসের ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত সময়কালের কার্যক্রম তদন্ত করে। প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা বার্ষিক অডিট প্রতিবেদন, দাখিলপত্র (মূসক-১৯) এবং বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের জমা করা ট্রেজারি চালানের কপি ও অন্যান্য দলিল থেকে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে গোয়েন্দা টিম।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সেবা খাতের বিপরীতে উৎসে মূসক বাবদ (তদন্ত মেয়াদে) মাত্র ৬৯৭ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির প্রদেয় ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত তথ্য গোপন করেছে মর্মে প্রমাণ পাওয়া যায়।

তদন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সেবা বিক্রির ওপর ৩০ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৭ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছে। কিন্তু তদন্তে উদঘাটিত হয় যে প্রতিষ্ঠানটির বিক্রির ওপর প্রযোজ্য ভ্যাটের পরিমাণ ছিল ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃত তথ্য গোপন করে ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এতে অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ৩ কোটি ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩ টাকা ফাঁকির তথ্য উদঘাটন করা হয়।

এছাড়া ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠানটি স্থান ও স্থাপনা ভাড়ার বিপরীতে কোনো ভ্যাট পরিশোধ করেনি। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির অপরিশোধিত ভ্যাট বাবদ ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য উদঘাটিত হয়। সব মিলিয়ে অপরিশোধিত ভ্যাটের পরিমাণ ৩ কোটি ৩৬ লাখ ৭৬ হাজার ৪৪১ টাকা এবং ২ শতাংশ হারে সুদ বাবদ মোট ৬ কোটি ৪০ লাখ ১২ হাজার ২৬২ টাকা।

যদিও ২০২১ সালে সুদসহ ৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৪ হাজার ৬২৮ টাকা ভ্যাট ফাঁকির তথ্যের কথা বলেছিল ভ্যাট গোয়েন্দা। ভ্যাট পরিশোধ না হওয়ায় যা বর্তমানে প্রায় ৬ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে বলে জানা গেছে। এর আগে ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগে ২০২১ সালের ২৯ জুন ভ্যাট আইনে মামলা দায়ের করার পর ঢাকা উত্তর কাস্টমস ও ভ্যাট কমিশনারেটে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছিল।

এ বিষয়ে ভ্যাট গোয়েন্দা অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক ও এনবিআরের বর্তমান সদস্য ড. মইনুল খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ভ্যাট আইনে মামলা করা হয়েছে। তদন্তকালে প্রতিষ্ঠানটিকে আত্মপক্ষ সমর্থনে একাধিকবার পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ভ্যাট আদায়ের আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণের জন্য তদন্ত প্রতিবেদনটি ঢাকা উত্তর ভ্যাট কমিশনারেটে পাঠানো হয়।

অন্যদিকে মেলোনেডস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও অভিযোগের বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরএম/এনএফ