প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে ২০১৫ সালের পণ্য বা উপকরণের দরের (রেট শিডিউল) অনুযায়ী। অথচ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) দরপত্র আহ্বানে দেখানো হয়েছে ২০১৮ সালের রেট। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই দরপত্র আহ্বান করে মালামাল কিনেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কাজটি করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার হেতেমদী থেকে সাগরদী বাজার পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পে এমন ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি প্রকল্পটি সংশোধনীর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) প্রস্তাব পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। প্রকল্প প্রস্তাবনায় গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় সবার নজর এড়িয়ে গেলেও আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি। সংশোধনী প্রস্তাবনা অনুমোদনের জন্য ফাইল এলে ডিপিপি বহির্ভুত কাজ হওয়াসহ বেশ কিছু অসঙ্গতি চিহ্নিত করে নোট দিয়ে ফাইল ফেরত পাঠান তিনি।

সংশোধনী প্রস্তাবনার নোটে প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী উল্লেখ করেছেন, ভূমি অধিগ্রহণ খাতে ৩২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা, নির্মাণ ও পূর্ত কাজের জন্য ৫ কোটি ৯১ লাখ টাকা ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যেই সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। উল্লেখিত কার্যক্রম পরস্পরবিরোধী। ব্যয় বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদনের পর প্রকল্প সংশোধন করা যাবে না। একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রীর এ সংক্রান্ত অনুশাসনও রয়েছে।

তিনি আরও লিখেছেন, অনুমোদিত ডিপিপিতে সওজের ২০১৫ সালের রেট শিডিউল অন্তর্ভুক্ত থাকার পরও কীভাবে ২০১৮ সালের রেট শিডিউলের ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করা হলো? ওই বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে জানাতে হবে।

এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার মেতেমদী থেকে সাগরদী বাজার পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ছিল মার্চ ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত। অর্থাৎ মোট সময় ২ বছর ১০ মাস। প্রকল্পের ২ বছর ৭ মাসে কাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এরমধ্যে ব্যয় বাড়ানো ছাড়া মেয়াদ ১ বছর বাড়ানো হলেও প্রকল্পটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে মনে হয় না। মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন মঞ্জুর না করে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে আইএমইডির সংশ্লিষ্ট সেক্টরকে জানাতে বলেছি।

আইএমইডি সংশ্লিষ্টরা জানান, ১১৬ কোটি ৩৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে মার্চ ২০১৭ থেকে ডিসেম্বর ২০১৯ সালে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় একনেক। লক্ষ্য অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় ব্যয় বাড়ানো ব্যতিরেকে দেড় বছর মেয়াদ বাড়িয়ে জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রস্তাব করা হয়। ব্যয় বাড়ানো ব্যতিরেকে মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনার জন্য প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি জানতে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে আইএমইডি সরেজমিনে প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করে।

এ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক নির্বাহী প্রকৌশলী মোফাজ্জেল হায়দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ প্রকল্পের ডিপিপি ২০১৫ সালের রেট শিডিউলে অনুমোদিত। কিন্তু মালামাল কেনার জন্য টেন্ডার আহ্বান করার সময় ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুমোদন হয়েছিল। ফলে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী টেন্ডারে অংশ নেয়।

তিনি বলেন, মালামাল কেনার জন্য আমি চিফ ইঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুমোদন করে নিই। ফলে অনুমোদিত রেট শিডিউল অনুযায়ীই এ প্রকল্পে কেনাকাটা করা হয়েছিল।

এখন পর্যন্ত প্রকল্পের মাত্র ৩ শতাংশ বাস্তবায়নের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ সংযোগ সড়কটি সম্পূর্ণ নতুন। যার ফলে ভূমি অধিগ্রহণে সময় লেগেছে। ভূমি অধিগ্রহণে স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারি অন্যান্য দপ্তর জড়িত থাকার কারণে সময় লেগেছে। তবে এখন যদি সময় বাড়ানো হয়, তাহলে আমাদের প্রস্তাবিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষ করতে পারবো।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকনোমিক ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেশিরভাগ সময় প্রকল্পে কেনাকাটার ক্ষেত্রে দেরি হয়। একবারে টেন্ডারিং হয়ে যায় এ ধরনের দৃষ্টান্ত খুব কম।

তিনি বলেন, আরেকটি বিষয় হচ্ছে যদি কোনো প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বিষয় থাকে এবং জটিলতা সৃষ্টি হয়, তাহলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হয়। এজন্য প্রকল্প অনুমোদনের আগেই সব সমস্যা নিষ্পত্তি করতে পারলে বাস্তবায়নের সময় সৃষ্ট জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

তিনি আরও বলেন, কোনো কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে দায়িত্ব দিতে চাইলে সেটা তারা নিয়ে নেন। কারণ একটি নতুন প্রকল্পে ঢুকলেই তো তাৎক্ষণিক উপকার থাকে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় আইটেম হলো বিদেশ ভ্রমণ। এরপর গাড়ির সুবিধা এবং অতিরিক্ত কিছু বেনিফিট পাওয়া যায়। এজন্য একজনকে একাধিক প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব কারণেই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হয়।

প্রকল্পে কেনাকাটায় রেট শিডিউলের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেনাকাটা যেগুলো হয়, সেগুলো সেগুলো ঠিক মতো হচ্ছে কি না, তার জন্য তো ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল অডিট করার কথা। অডিট তো কাজ করার পরে আসে। কেনাকাটার আগে অভ্যন্তরীণ নিয়মনীতির ব্যবস্থা থাকে। কোনো প্রকল্পে কে কেনাকাটা করবেন, কিসের ভিত্তিতে করা হবে- সেগুলো মাসে বা তিনমাসে সচিবকে জানাতে হয়। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশনকে প্রত্যেক প্রকল্পের কেনাকাটার বিষয়ে জানাতে হয়।

তিনি আরও বলেন, আমরা প্রায়ই দেখি অসঙ্গতি ধরা পড়ে। আইএমইডি রিপোর্টটি যখন মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠায়, তখন তারা যদি কোনো অ্যাকশন না নেয়, তাহলে তো এখানে আর কোনো অ্যাকাউন্টিবিলিটি থাকলো না। তখন অসঙ্গতিগুলো প্রশ্রয় পেয়ে যায়। একজনকে প্রশ্রয় দিলে আরেকজনও সুযোগ নেন।

আইএমইডির সুপারিশ না মানলে কী করা উচিত- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ বলেন, মন্ত্রণালয়ের আলটিমেট দায়িত্বে মন্ত্রী এবং সচিব থাকেন। অ্যাকাউন্টিবিলিটি তো তাদের ওখানেই থেমে যাওয়ার কথা। বছর শেষে একজন প্রকল্প পরিচালক চুক্তি অনুযায়ী কী করলেন বা কোনো অনিয়ম, দুর্নীতি করলেন কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। ভালো কাজে পুরস্কার আর খারাপ কাজে তিরস্কার- না থাকলে পরিস্থিতি বদলাবে না।    

এসআর/আরএইচ/এসএম