সদ্য সমাপ্ত বছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ছয় লাখ টাকা। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ার হোল্ডারদের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। যা সম্পূর্ণভাবে আইনের লঙ্ঘন। তাতে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ বাবদ ২ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার টাকার শেয়ার দিতে হবে।

অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডারদের আরও অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৬ টাকা দিতে হবে। কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এই চিত্র দেখা দিয়েছে।

পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ বলছে, কোম্পানিটি আইন মেনে লভ্যাংশ ঘোষণা করেনি। এর ফলে নিয়মের বাইরে যে পরিমাণ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করা হয়েছে তার বিপরীতে তাদের ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সোনালী আঁশ শেয়ার হোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। বর্তমানে কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ২ কোটি ৭১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই বোনাস শেয়ার লভ্যাংশের ফলে পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি পাবে। তবে ৩০ শতাংশের নির্দেশনা পরিপালন হবে না। এছাড়াও অনুমোদিত মূলধন ১০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকা উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানিটি।

নিয়ম অনুযায়ী, মুনাফার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ এবং সমপরিমাণে নগদ ও বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করতে হয়। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি দ্বিতীয় বিধান লঙ্ঘন করেছে। অর্থাৎ নিয়ম বহির্ভূতভাবে শেয়ারহোল্ডারদের জন্য বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ করেছে। নিয়ম ভঙ্গের দায়ে কোম্পানিটিকে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২৭ লাখ ১২ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে।

কোম্পানিটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে অনুযায়ী, ২০২০-২০২১ সমাপ্ত বছরের কোম্পানির কর বাদে মুনাফা হয়েছিল ৩০ লাখ ৫৯ হাজার ১১৮ টাকা।

জুলাই ২০২১-২০২২ সমাপ্ত বছরে করসহ খরচ বাদে মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ ৩৮ হাজার ২৪৩ টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে ৭৫ লাখ ৭০ হাজার ১২৫ টাকা বেড়েছে। তাতে ২০২২ সালে কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় (ইপিএস) দাঁড়িয়েছে ৩ টাকা ৯২ পয়সা। এর আগের একই সময়ে ইপিএস ছিল ১ টাকা ১৩ পয়সা। অর্থাৎ ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে কোম্পানির মুনাফা বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। মুনাফা বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রত্যাশা ছিল গত বছরের চেয়ে এ বছর আরও বেশি নগদ লভ্যাংশ দেবে কোম্পানিটি। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের সেই আশায় গুড়ে-বালি।

উল্টো ২০২২ সালের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে ১৬ নভেম্বর কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ার হোল্ডারদের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। তাতে ২৭ লাখ ১২ হাজার শেয়ারের বিপরীতে বিনিয়োগকারীদের মোট ২ কোটি ৭১ লাখ ২০ টাকার লভ্যাংশ দিতে হবে। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত বছরে কোম্পানির মুনাফা হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ টাকা। বাকি ১ কোটি ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৬ টাকার শেয়ার দেওয়া হবে কোম্পানির রিজার্ভ ফান্ড থেকে। এতে কোম্পানির ভীত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রশিদ সিকিউরিটিজের বিনিয়োগকারী আহাম্মদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোম্পানিটির ব্যবসা না বেড়ে যদি মূলধন বাড়ানো হয়, তবে শেয়ার হোল্ডাররা মুনাফা কম পাবেন। সুতরাং এ কোম্পানিতে ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করবেন না বিনিয়োগকারীরা। ফলে শেয়ারের দাম আস্তে আস্তে কম কমে যাবে। কোম্পানির সক্ষমতা অনুসারে মূলধন বাড়ানো উচিত।

পর্ষদ সভায় বোনাস লভ্যাংশ অনুমোদনের জন্য কোম্পানির বার্ষিক সভার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। তার জন্য রেকর্ড ডেট (দিন) নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৭ ডিসেম্বর। বিনিয়োগকারীরা ইচ্ছে করলে সে দিন বোনাস লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে অধিকাংশ বিনিয়োগকারীদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জেনে বুঝে নিয়ম ভঙ্গ করে এই লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোম্পানির পর্ষদ। এ বিষয়ে সোনালী আঁশের সচিব হাবিবুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নির্দেশনাকে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পর্ষদ।

তিনি বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থার চলতি বছরের মধ্যে পরিশোধিত মূলধন ন্যূনতম ৩০ কোটি টাকায় উন্নীত করতে বলেছে। বিএসইসির সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য এ বছর পুরোটাই বোনাস শেয়ার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ৩০ কোটি হবে না। এজন্য আমাদের আরও সময় লাগবে। এই শর্ত মানতে গিয়ে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী অতিরিক্ত কর দিতে হবে।

এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল-আমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কী কারণে কোম্পানিটি এত পরিমাণে বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিচ্ছে তা বিএসইসিকে খতিয়ে দেখা উচিত। যৌক্তিক কারণ না থাকলে বোনাস শেয়ারের প্রস্তাব বাতিল করা উচিত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইন অনুযায়ী কোম্পানির মোট মুনাফার ন্যূনতম ৩০ শতাংশ লভ্যাংশ দিতে হয়। অন্য একটি আইনে বলা হয়েছে, নগদ ও বোনাসের সমপরিমাণ লভ্যাংশ দিতে হয়। এর ব্যত্যয় হলে আইন অনুযায়ী যে শাস্তি রয়েছে তা ভোগ করতে হবে।

তিনি বলেন, কোম্পানি আইন অনুযায়ী সোনালী আঁশের পরিচালনা পর্ষদ সভায় লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন এজিএমে পাস হলে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য কমিশনে আবেদন করবে। কোম্পানি যদি যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারে তবে বিএসইসি প্রস্তাব বিবেচনা করবে। যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারলে বোনাস লভ্যাংশের বিষয়টি কমিশন বাতিল করতে পারে।

কেন জরিমানা?

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে অন্তত অর্ধেক বোনাস ও অর্ধেক নগদ দেওয়ার বিধান রয়েছে। সোনালী আঁশের পরিচালনা পর্ষদ সেই আইন ভঙ্গ করে ১০০ শতাংশের (২ কোটি ৭১ লাখ টি শেয়ার) বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে।

অর্থাৎ শতভাগ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে শাস্তি হিসেবে কোম্পানিকে বোনাস শেয়ারের ওপর ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিতে হবে। অর্থাৎ ২৭ লাখ ১২ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। 

আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা সংযোজন

অর্থ আইন, ২০১৯ এর মাধ্যমে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন ধারা (১৬ নম্বর) সংযোজন করা হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত কোম্পানিকে স্টক ডিভিডেন্ডের কমপক্ষে সমপরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ড দিতে হবে। যদি স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়ার পরিমাণ ক্যাশ ডিভিডেন্ডের চেয়ে বেশি হয় তাহলে যে পরিমাণ স্টক ডেভিডেন্ড দেওয়া হবে বা হয়েছে তার পুরোটার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর আরোপ করা হবে। এ কর কোম্পানিকে সংশ্লিষ্ট কর বছরের আয়কর রিটার্ন দাখিলের আগে পরিশোধ করতে হবে। এটি অন্য কোনো করের সঙ্গে সমন্বয় করা যাবে না। 

কোম্পানির বর্তমান অবস্থা:

২০২০-২০২১ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে কোম্পানির মোট ঋণ রয়েছে ৯৬ কোটি ২৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদী ঋণ রয়েছে ৫৪ কোটি ৪১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আর দীর্ঘমেয়াদী ঋণ রয়েছে ৪১ কোটি ৮৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ১০ টাকা অভিহিত মূল্যের বৃহস্পতিবার সর্বশেষ লেনদেন হয়েছে ৮০৬ টাকা ২০ পয়সা। তাতে কোম্পানি ২৭ লাখ ১২ হাজার শেয়ারে বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ২০১ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

১৯৮৫ পাট খাতের তালিকাভুক্ত হওয়ার পর কোম্পানিটি ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে শেয়ার হোল্ডারদের ১০ শতাংশ করে লভ্যাংশ দিয়েছে। অর্থাৎ শেয়ার প্রতি এক টাকা করে দিয়েছে। তবে ২০১০ সালে ১৫ শতাংশ নগদ আর ২০ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছিল।

কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে রয়েছে ৫০ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ার, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে শেয়ার রয়েছে ৪৩ দশমিক ৫৯ শতাংশ।

এমআই/কেএ