কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেই। তারপরও ‘ব্যাংক’ নাম দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। সমবায় অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে একের পর এক শাখা খুলছে স্মল ট্রেডার্স কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড তথা এসটিসি ব্যাংক। 

ইতোমধ্যে আইন লঙ্ঘন করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেটসহ সারাদেশে ৩০০টির বেশি শাখা খোলা হয়েছে। সমবায় অধিদফতরের বিধিবিধান লঙ্ঘন করে চলছে অর্থ লেনদেন। চাকরি দেওয়ার নামে চলছে অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাহকের সঙ্গে চলছে নানা প্রতারণা।

শ্রীমঙ্গলের ফারুক মিয়া বেশি লাভ পাওয়ার আশায় সাড়ে চার লাখ টাকার এফডিআর করেছিলেন ২০১৮ সালের ২৯ এপ্রিল। তিন মাস অন্তর মুনাফার টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এক টাকাও পাননি ফারুক। এখন আসল টাকা ফেরত পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান তিনি।

ব্যাংকের ন্যায় নাম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি (STC Bank Limited) সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, ওয়েবসাইট খুলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এছাড়া এফডিআর রশিদ, জমাবই, চেকবই ইত্যাদি ছাপিয়ে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। যা সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর

আরেক ভুক্তভোগী আব্দুল মোমেন। ২০১১ সালে শর্ত অনুযায়ী দুই লাখ টাকা জমা দিয়ে চাকরি শুরু করেন। বেশকিছুদিন চাকরিও করেন কিন্তু কোনো বেতন পাননি। এফডিআরবাবদ মাসে দুই হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা ছিল। তাও দেয়নি। এখন আসল টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় তিনিও।

তথাকথিত ব্যাংকটির শ্রীমঙ্গল শাখার আরেক ভুক্তভোগী গ্রাহক মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটিতে তিন লাখ টাকার এফডিআর করেছিলেন। মঞ্জুরুল ঢাকা পোস্টকে জানান, তিন লাখ টাকার এফডিআর করি। কোনো লাভ দেয়নি। এখন আসলও ফেরত দিচ্ছে না। শাখায় গিয়েও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। মোবাইলে বেশকিছুদিন ধরে কল দেন। কিন্তু নম্বরটি বন্ধ পাচ্ছেন।

শুধু মঞ্জুরুল, ফারুক আর মোমেন নন, এমন হাজারও গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এসটিসি ব্যাংক। হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। সম্প্রতি এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের ছয়টি শাখা পরিদর্শন শেষে একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ কার্যক্রমের প্রমাণ পাওয়ায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং সরকারকে চিঠি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

ব্যাংকটির ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৩০০-এর অধিক শাখা রয়েছে। ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪৪টির। এসব শাখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, ব্যাংকের ন্যায় নাম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি (STC Bank Limited) সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, ওয়েবসাইট খুলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এছাড়া এফডিআর রশিদ, জমাবই, চেকবই ইত্যাদি ছাপিয়ে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে শাখা খুলে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। যা সাধারণ আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী এবং ব্যাংক খাতের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সম্প্রতি শ্রীমঙ্গলে একটি শাখা খুলে জনগণের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অবৈধ ব্যাংকটি। শাখার কার্যক্রম উদ্বোধনের জন্য পরপর দুই থেকে তিনবার ওই এলাকায় সফর করেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমান। প্রথমদিকে তার ব্যক্তিগত মোবাইলে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও পরবর্তীতে সেই নম্বর বন্ধ করে দেন তিনি। অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের বিষয়টি বুঝতে পেরে সেই শাখাটিও সিলগালা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে আরও উঠে এসেছে যে, ব্যাংকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের কাছ থেকে ১৫ হাজার থেকে তিন লাখ পর্যন্ত টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে না। কোনোপ্রকার লিখিত পরীক্ষা বা মৌলিক সাক্ষাৎকার না নিয়ে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটি নিয়মবহির্ভূতভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয় অধিদফতর যখন ব্যবস্থা নিতে গেল, তারা তখন আদালতে একাধিক মামলা করে বসল। দুটি মামলার রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। সেই অনুযায়ী এসটিসি ব্যাংকের শাখাগুলো বন্ধ করতে আমাদের জেলা অফিস এবং জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন

জেবুন নাহার, যুগ্ম নিবন্ধক, সমবায় অধিদফতর

এ অবস্থায় অনুমোদনহীন এসটিসি ব্যাংকের সব কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের মে মাসে রাজশাহী মহানগরীর বর্ণালী মোড়ে মরিয়ম আলী টাওয়ারের চতুর্থ তলায় ব্যাংকটির আঞ্চলিক শাখা অফিস খোলা হয়। ইসলামী শরিয়াহ ভিত্তিক পরিচালনার কথা বলে সঞ্চয়, ডিপিএস ও চলতি হিসাবসহ সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে এসটিসি। তবে নাম ব্যাংক আর অনুমোদন সমবায় অধিদফতরের হওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে এ নিয়ে আতঙ্ক দেখা দেয়। এর বাইরে নগরীর সাগরপাড়ায় এসটিসি ব্যাংক লিমিটেডের রাজশাহী শাখা ও বিভাগীয় কার্যালয়, পবা থানার পাশে নওহাটা শাখা অফিস, বানেশ্বর ফাতেমা হক প্লাজায় (তৃতীয় তলায়) বানেশ্বর শাখা অফিস, মোহনপুরের কেশরহাটে একটি শাখা অফিস, তানোর পৌরশহরের চেয়ারম্যান প্লাজার দ্বিতীয় তলায় তানোর শাখা অফিস, বাগমারার ভবানীগঞ্জ বাজারের গোডাউন মোড়ে ভবানীগঞ্জ শাখা অফিসসহ রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অবাধে ব্যাংকের মতো শাখা-প্রশাখা খুলে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে জানা যায়, এসটিসি ব্যাংক সমবায় অধিদফতর থেকে সমবায় সমিতি হিসেবে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ জেলায় কাজের অনুমতি নেয়। সংশোধিত উপ-আইন অনুযায়ী কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ এর ১২ (২) পরিপন্থী। এছাড়া সমবায় আইন ২০০১, সংশোধিত ২০০২ ও ২০১৩ এর ২৩ (১) ধারা অনুযায়ী, কোনো সমবায় সমিতি তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শাখা অফিস খুলতে পারবে না এবং সমবায় সমিতি আইনের ২৬ ধারা অনুযায়ী সদস্য ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়ম-নীতি তোয়াক্কা না করে সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহার করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি।

রাজধানীর মৌচাকে অবস্থিত এটির প্রধান কার্যালয়। সরেজমিনে সেখানে গিয়ে তা বন্ধ পাওয়া যায়। গেটের সামনে ময়লার স্তূপ। আশপাশের লোকজন জানান, অনেকদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ। অফিসে কেউ আসেন না। মাঝেমধ্যে কিছু লোকজান আসেন, কিন্তু বন্ধ দেখে চলে যান।

ব্যাংকটির ওয়েবসাইট ও প্রসপেক্টাস ঘেঁটে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানটির ৩০০-এর অধিক শাখা রয়েছে। ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র ৪৪টির। এসব শাখার মাধ্যমে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। দৈনিক সঞ্চয় প্রকল্প, মুদারাবা মাসিক সঞ্চয়, মুদারাবা শিক্ষা সঞ্চয়, মুদারাবা হজ সঞ্চয় নামে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা ব্যাংকের মতো আমানত নিচ্ছে। এছাড়া সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা মূল্যমানের শেয়ারও বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব শেয়ারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অংশীদার’, ‘নিকট’, ‘আস্থা’, ‘বিশ্বাস’, ‘প্রিয়’, ‘আমার’ ও ‘আপন’।

অন্ধকারাচ্ছন্ন মৌচাকের এসটিসি প্রধান কার্যালয়

ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানসহ পরিচালকের সংখ্যা মোট সাতজন। বাকি ছয়জনের মধ্যে চারজনের কোনো ছবি প্রকাশ করা হয়নি। অন্যদিকে, গ্রাহক আকৃষ্ট করতে ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় লেখা রয়েছে, ‘২০১৯ সাল থেকে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করেছে এসটিসি ব্যাংক লিমিটেড। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্ত ও স্থিতিশীল ভূমিকা রাখছে তারা। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যাপক পরিসরে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে এসটিসি ব্যাংক। সীমিত বন্ধক দিয়ে গৃহঋণ, আশ্চর্যজনক পুরস্কার (সুদহার), কর্তব্যনিষ্ঠ ও অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা দিয়ে আসছে তারা।’

এসব বিষয়ে এসটিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মির্জা আতিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় অধিদফতরের যুগ্ম নিবন্ধক (ব্যাংক, বিমা ও কৃষিঋণ) জেবুন নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানটি নিয়মবহির্ভূতভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয় অধিদফতর যখন ব্যবস্থা নিতে গেল, তারা তখন আদালতে একাধিক মামলা করে বসল। দুটি মামলার রায় আমাদের পক্ষে এসেছে। সেই অনুযায়ী এসটিসি ব্যাংকের শাখাগুলো বন্ধ করতে আমাদের জেলা অফিস এবং জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। 

এসআই/এমএআর/