খেজুরের কদর সারা বছর থাকলেও রমজানে তা ভিন্ন মাত্রা পায়। ইফতারে প্রত্যেক মুসল্লির প্লেটে খেজুর থাকা চাই। আর সে সুযোগটাই নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রমজান সামনে রেখে বাড়তে শুরু করেছে খেজুরের দাম। 

খেজুরের আমদানিকারকরা যদিও বলছেন, তারা দাম বাড়াননি, রমজানে খেজুরের দাম বাড়ার সম্ভাবনাও নেই। রমজানে জাহেদী, বড়ই এবং খুরমা খেজুর কেনেন ৮০ শতাংশ ক্রেতা। এগুলোর দাম বাড়বে না। তবে তাদের এ কথার সত্যতা মেলে না বাজারে। বাদামতলীর আড়তগুলোতে মধ্যমানের বড়ই, দাবাস, নাগাল ও সায়ের খেজুরের দাম কেজি প্রতি ৫ টাকা বেড়ে গেছে। আর খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে আরও বেশি।

ব্যবসায়ীদের দাবির উল্টো চিত্র দেখা গেছে, রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, রামপুরা এবং বাড্ডা এলাকার বাজারগুলোতেও। সবচেয়ে নিম্নমানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০-২০০ টাকা কেজি দরে। মধ্যমানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে কেজি ২০০-৩৫০ টাকায়, তার চেয়ে ভালো মানের খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৫০০ টাকা কেজি দরে। আর আজোয়া ও মরিয়মসহ ব্রান্ডের ভালো খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা কেজিতে। 

ক্রেতারা বলছেন, রমজানকে কেন্দ্র করে চাল, তেল এবং পেঁয়াজের মতোই খেজুরের দাম বাড়তে শুরু করেছে। পাইকারি বিক্রেতারা বলছেন, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া থেকে বড়ই, দাবাস এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা নাগাল ও সায়ের খেজুরের দাম কিছুটা বেড়েছে। 

রমজানে গত বছরের তুলনায় এ বছর খেজুরের দাম সস্তা। দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমরা আগে খেজুর আমদানি করেছিলাম। তবে এখন আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফল আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী সিরাজুল ইসলাম

আড়তদার এবং খেজুর-বাজার নিয়ন্ত্রণকারী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, গত বছরের চেয়ে এ বছর খেজুর সস্তা রয়েছে। সবচেয়ে ভালো আজোয়া ও মরিয়ম খেজুর এ বছর সবচেয়ে কম দামে বিক্রি হচ্ছে। রমজানে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা থাকে। এ বছর প্রায় ৫০ হাজার টন খেজুর আমদানি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত খেজুর পর্যাপ্ত মজুদ আছে। ফলে খেজুরের দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

দেশের সবচেয়ে বড় ফলের বাজার রাজধানীর বাদামতলীতে গিয়ে দেখা গেছে, তিউনিসিয়া থেকে আসা লুলু অর্থাৎ বড়ই খেজুর (১০ কেজির কার্টন) বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকায়। এই খেজুরটি এক সপ্তাহ আগে ১৩০০-১৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ১৩৫০ টাকা করে সৌদি থেকে আনা নাগল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৪০০ টাকা কার্টন। ১৭৫০ টাকার দাবাসের কার্টন বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ টাকায়। এছাড়াও কম দামি সায়ের খেজুর ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

আর ইরাক থেকে আনা জাহেদী খেজুর পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬৫ টাকা কেজি দরে। একই খেজুর প্যাকেটজাত হয়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা কেজিতে। এই খেজুরটি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) সারা দেশে বিক্রি করছে। দুবাই থেকে আনা এমিরেট গোল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৯২ টাকা কেজি দরে। খালাস খেজুরের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা দরে। জারবি ৯০ টাকা এবং বারনী ১০৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

টিবিসির তথ্য অনুসারে, এক বছর আগে যে খেজুর বিক্রি হয়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা দরে, সেই খেজুর বৃহস্পতিবার রাজধানীর খুচরা বাজার ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। 

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি খেজুর উৎপাদন হয় মিসরে। এরপর আছে সৌদি আরব, ইরান, আলজেরিয়া, ইরাক, পাকিস্তান, সুদান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং তিউনিশিয়া। এর মধ্যে কম দামি খেজুর আসে সংযুক্ত আরব আমিরাত অর্থাৎ দুবাই থেকে। এছাড়াও তিউনিসিয়া, আলজেরিয়া, পাকিস্তান, ইরান থেকে কম দামি খেজুর আসে বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে পাওয়া যাওয়া দামি খেজুরের মধ্যে রয়েছে- আজোয়া, মরিয়াম, সাফওয়ী, সেগাই এবং বারহি খেজুর। এই খেজুর আমদানি করেন ৫০-৬০ ভাগ ব্যবসায়ী। মূলত এই খেজুরের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন হাজী মোহাম্মদ সেলিম, হাজী বরাত মিয়া, হাজী সিরাজুল ইসলাম ও হাজি আফসার উদ্দিন।

এই চার ব্যবসায়ীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বাংলাদেশ ফল আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী সিরাজুল ইসলাম। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রমজানে আমাদের খেজুর প্রয়োজন হয় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন। আমদানির পরিমাণও প্রায় ৫০ হাজার টন। আমরা এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ খেজুর আমদানি করেছি, রমজানের জন্য কোনো সমস্যা হবে না।

তিনি বলেন, রমজানে গত বছরের তুলনায় এ বছর খেজুরের দাম সস্তা। দাম বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কারণ, আমরা আগে খেজুর আমদানি করেছিলাম। তবে এখন আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।  জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে, কন্টেইনার পাওয়া যাচ্ছে না। কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে আসতে সময় বেশি লাগছে। আমরা আগে নিয়ে এসেছি, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের কোনো সমস্যা নেই।

শেষ চার বছরে খেজুর আমদানির চিত্র

হাজী বরাত মিয়ার ছেলে হাজী মাসুম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবার খেজুরের দাম কম। রমজানে খেজুরের দাম বাড়বে না। কারণ, লকডাউন খোলার পর আমরা পর্যাপ্ত খেজুর আমদানি করেছি। দামও তুলনামূলক কম ছিল।

মেসার্স মানিক এন্টারপ্রাইজে ৮ বছর ধরে কর্মরত রাকিব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এ বছর খেজুরের দাম অনেক কম। কারণ প্রচুর পরিমাণ খেজুর আমদানি হয়েছে। 

খুচরা বাজারের চিত্র 

পল্টনের বায়তুল মোকাররম এলাকার খেজুরের দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, খুরমা খেজুর সর্বনিম্ন ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। বড়ই খেজুর ২৫০-৩৩০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। প্রকারভেদে মরিয়ম খেজুর বিক্রি করছেন ৬০০-১ হাজার টাকা কেজিতে। আর আজোয়া খেজুর বিক্রি করছেন ৮০০-১৪০০ টাকা কেজি দরে।

ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, খেজুরের মধ্যে আজোয়া সবচেয়ে দামি। এই খেজুর ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা কেজি ছিল। গত বছর হজ ও ওমরা বন্ধ থাকায় খেজুরের দাম কমেছে। ফলে ৩ হাজার টাকার খেজুর এখন হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অনেকে সকালের নাস্তা রুটি আর খেজুর দিয়ে করছেন।

সেগুনবাগিচার ব্যবসায়ী জানান, বড়ই খেজুর সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এই খেজুর ২২০ টাকা কেজি। খুরমা খেজুর ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি। এর নিচে কোনো খেজুর নেই। বাড্ডা এলাকার দোকানদার রিপন মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার দোকানে সর্বনিম্ন ১৫০ টাকা দামের খেজুর আছে।

এমআই/এনএফ/আরএইচ