ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এখন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম পড়বে ১২ টাকা। একইসঙ্গে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়া কথাও বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। বৃহস্পতিবার এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে চারটি প্রতিষ্ঠান ডিম আমদানির অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে।

মন্ত্রীর ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রয়ায় জানতে চাইলে ব্যবসায়ী ও পোল্ট্রি খাত সংশ্লিষ্টরা বলেন, ডিমের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এই দামে বিক্রি করতে হলে খামারিদের উৎপাদন খরচ, পাইকারি, আড়ৎদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা কে কত লাভে বিক্রি করবে তা নির্ধারণ করা উচিৎ ছিল।

ডিমের দাম নির্ধারণকে স্বাগত জানালেও আমদানির সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, ডিম আমদানি করলে এই শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। পরে আরও বেশি দামে ডিম খেতে হবে।  

বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিআইএ) মহাসচিব ও ইউনাইটেড অ্যাগ্রো কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী খন্দকার মুহাম্মদ মহসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কোনো সেক্টর আমদানি নির্ভর হলে তার ফলাফল ভালো হয় না।

তিনি বলেন, বাজারে অল্পকিছুদিন দামে ডিমের ঘাটতি ছিল, এ কারণে দাম বেড়েছে। দাম কমাতে ডিম আমদানি করতে হবে, তা আমরা কাম্য মনে করি না। পোল্ট্রি সেক্টর একমাত্র সেক্টর আমরা আমদানি নির্ভর না। এই শিল্পে সাময়িক যে সমস্যা রয়েছে, তা আমরা ওভারকাম করতে পারবো। আমার মনে হয় না আমদানির দরকার আছে।

আমদানি করা হলে কী প্রভাব পড়তে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভারতে ডিমের দাম কম, সরকার যদি ভারত থেকে ডিম আমদানি করে তাহলে ডিমের দামে সামান্য প্রভাব পড়বে। তবে প্রভাব পড়বে পোল্ট্রি  শিল্পে সেটা হলো এই শিল্প আমদানি নির্ভর হয়ে পড়বে। পেঁয়াজ, চিনি বা চালের দামের ইচ্ছা অনুয়ায়ী ডিমের দাম বাড়বে। এটা ভোক্তা পর্যায়ে অসঙ্গতি বাড়তেই থাকবে।

ফিডের দাম বাড়তির কারণে ৬০ হাজার খামার বন্ধ রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে ১২ টাকা ডিম বিক্রি করলে খামারিরা কত দামে বিক্রি করবে সেটা নির্ধারণ করা দরকার। খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ে যেতে যে হাত বদল হয়, তাতে কার কত লাভ হবে তা নির্ধরাণ করা উচিৎ। ১২ টাকা নির্ধারণ নিয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।

আরও পড়ুন : কারণ ছাড়াই বেড়েছে আলু-পেঁয়াজ-ডিমের দাম

বিপিআইএ মহাসচিব বলেন, আমরা চাই, এই শিল্পকে যেন আমদানি নির্ভর না করা হয়। আমদানি করা হলে শিল্পটা ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠিত শিল্পকে পথে বসানো হবে।

বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে ডিমের মূল্য ১২ টাকা নির্ধারণ করা এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এক্ষেত্রে পাইকার, আড়ৎদার এবং খুচরা ব্যবসায়ীরা কত  টাকা লাভে বিক্রি করবে তাও সরকারকে নির্ধারণ করে দিতে হবে।

ডিম আমদানি বিষয়ে তিনি বলেন, দাম কমানোর অযুহাতে ডিম আমদানি করা যাবে না। ডিম আমদানি শুরু হলে দেশীয় শিল্প নষ্ট হয়ে যাবে। তারপরে সব সময় ডিম আমদানি করে খেতে হবে। দাম বেশি দিতে হবে।

তিনি বলেন, যেসব ব্যবসায়ী ডিম আমদানি করতে চায়, তারাই সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছে। তাদের মাধ্যমে ডিম আমদানি করা হলে এই শিল্প টিকবে না। দেশের লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান নষ্ট হবে।

যা বললেন মন্ত্রী

আজ দুপুরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, প্রথমে অল্প পরিমাণে ডিম আমদানি করা হবে। এরপরও যদি দাম না নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে ব্যাপক আকারে আমদানি করা হবে।

আরও পড়ুন : রেকর্ড মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী মুরগি ও ডিম : পরিকল্পনামন্ত্রী

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা হওয়ায় আমরা এই দাম নির্ধারণ করে দিয়েছি। প্রতি পিস ডিম এখন থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করা হবে। প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।

ডিম আমদানির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজার পর্যালোচনা করে সীমিত আকারে ডিম আমদানির অনুমোদন দেওয়া হবে। যদি ডিম প্রতি পিস ১২ টাকাতেই খুচরা পর্যায়ে বিক্রি করা হয়, তাহলে আমদানির বিষয়টি অতো গুরুত্ব পাবে না, সীমিত আকারে করা হবে। কিন্তু দাম ১২ টাকায় সীমিত না থেকে বাড়ানো হয়, কিংবা সুযোগ নেওয়া হয়, তাহলে বেশি করে আমদানি করা হবে। বাজার ঠিক রাখার জন্য আমদানি করা হবে।

এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ভোক্তা অধিকার থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকরা (ডিসি) বাজার মনিটরিং করবেন বলেও জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, জেলা-উপজেলাসহ বড় বড় শহরগুলোতে এই মনিটরিং চলবে। আজকের ঘোষণার পরে সর্বাত্মক শক্তি নিয়ে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

ডিমের চাহিদা কত

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে দৈনিক ডিমের চাহিদা সাড়ে তিন থেকে চার কোটি পিস। পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সংগঠনগুলোর মতে, বর্তমানে ডিমের চাহিদা রয়েছে চার কোটি ৭০ থেকে ৮০ লাখ পিসের। উৎপাদন হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ। বাকি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ডিমের ঘাটতি রয়েছে।

এ ঘাটতির সুযোগে ব্যবসায়ীরা ডিমের দাম বাড়িয়েছে। সরকারের তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে ২৩৩৫ কোটি ৩৫ লাখ পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০৫৭ কোটি ৬৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৪৩৬ কোটি পিস, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১৭১১ কোটি পিস। তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫৫২ কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি বছর ডিমের উৎপাদন বাড়ছে।

ডিমের উৎপাদন খরচ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলার সংকটসহ বিদ্যমান সমস্যার কারণে মুরগির খাবারের দাম বেড়েছে। ফলে খামারিদের দাবি এক পিস ডিমের উৎপাদন খরচ বর্তমানে ১১ টাকা। তবে, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মতে এ খরচ ১০ টাকা ২০ পয়সা। ব্যবসায়ীদের দাবি, গত দুই কিংবা তিন মাসের মধ্যে ডিমের দাম বাড়েনি।

মূল্য কম ও হওয়ার উচিত

দেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি পিস ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা। খামারিদের দাবি, উৎপাদন খরচ ১১ টাকা। তারা খামার-পর্যায়ে প্রতিটি ডিম বিক্রি হচ্ছে ১১ টাকা ৫০ পয়সায়। তাই খুচরা বাজারে ডিমের দাম সর্বোচ্চ ১৩ টাকা হওয়া উচিত। তবে, খামারিদের এ দাবি সত্য নয়— বলছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, খামার থেকে প্রতিটি ডিম কিনতে হচ্ছে ১২ টাকা ২০ পয়সা থেকে ১২ টাকা ৫০ পয়সায়। তারা বেশি দামে ডিম বিক্রি করছে কিন্তু রসিদ দিচ্ছে না।

এমআই/এসএম