সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মহি

ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাত হাজার ৩৯৮ ভরি স্বর্ণ আত্মসাতের মামলার আসামি তিনি। শুধু তাই নয়, গ্রাহকের আমানতের ১৩ হাজার ২২৫ ভরি স্বর্ণ আত্মসাতেরও অভিযোগ আছে। এছাড়া ঘুষ নিয়ে বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যের প্রমাণ মিলেছে তার বিরুদ্ধে। এতকিছুর পরও বহাল তবিয়তে আছেন সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মহি। উল্টো এসব অভিযোগের দায় এড়িয়ে ‘সম্পূর্ণ নিরপরাধ’ বলে দাবি করেছেন তিনি।

২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বর সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মহির বিরুদ্ধে স্বর্ণ জালিয়াতি, ঘুষ বাণিজ্য ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আসে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মহিউদ্দিন আহমেদ মহিসহ নয়জনের বিরুদ্ধে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা- ১ এ মামলা করেন সংস্থাটির উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। রাজধানীর সেগুনবাগিচা থেকে ওইদিনই পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ব্যাংকের চেয়ারম্যান জামিন নিলেও ফেঁসে যান দায়িত্বরত পাঁচ কর্মকর্তা। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে হাজত খাটছেন তারা। সম্প্রতি তাদের মধ্যে দুজনের জামিন হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা থেকে মোট ৩৩৫ গ্রাহকের এক হাজার ৫৯৪ ভরি ১৪ আনা স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছে চেয়ারম্যান চক্র। গড়ে ১৮ ক্যারেট হিসেবে প্রতি ভরি ৫৪ হাজার ১৮০ টাকা ধরে মোট আট কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা

ওই মামলায় গ্রেফতার হন- সমবায় ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক আব্দুল আলিম, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (হিসাব) হেদায়েত কবীর, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার ও সমবায় ভূমি উন্নয়ন ব্যাংকের এস এস রোড শাখার ব্যবস্থাপক মো. মাহাবুবুল হক, প্রিন্সিপাল অফিসার মো. ওমর ফারুক ও সিনিয়র অফিসার (ক্যাশ) নূর মোহাম্মদ।

সমবায় ব্যাংক, মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকা

সমবায় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ঋণের বিপরীতে ১৩ হাজার ২২৫ ভরি স্বর্ণ জামানত রেখেছিল নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড। তবে দীর্ঘ ১০ বছরেও সে ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। বহুবার চিঠি দিয়েও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে সমবায় ব্যাংকের ৩০তম ব্যবস্থাপনা কমিটির ৫১তম সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত আসে। এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে বন্ধকি ঋণের বিপরীতে মেয়াদোত্তীর্ণ স্বর্ণ বিক্রি করা হবে জানানো হয়। তা না হলে ব্যাংকের তারল্য সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা যায়।

মোট পাঁচ হাজার ৮০৩ ভারি ১৩ আনা স্বর্ণ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। জুয়েলারি সমিতির মূল্য তালিকা অনুযায়ী ওই সময় সেসব স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা

সূত্র জানায়, গ্রাহক নিখোঁজের সুযোগটি কাজে লাগায় ব্যাংকের একটি চক্র। গ্রাহকের পরিচয়পত্র নকল করে সমবায় ব্যাংকে আবেদন করার নাটক সাজায় চক্রটি। স্বর্ণ ফেরত পেতে এক হাজার ৯৮৪টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। কিন্তু এর বেশিরভাগই ছিল ভুয়া।

৭৩৯৮ ভরি স্বর্ণ আত্মসাতের মামলার আসামি মহিউদ্দিন আহমেদ মহি 

দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে আরও ভয়াবহ তথ্য। সংস্থাটির অনুসন্ধান প্রতিবেদন বলছে, নারায়ণগঞ্জ কো-অপারেটিভ ক্রেডিট লিমিটেড কর্তৃক স্বর্ণ ফেরত পেতে সমবায় ব্যাংক বরাবর মোট এক হাজার ৯৮৪টি আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে মাত্র তিনটি আবেদনপত্র সঠিক ছিল। বাকি এক হাজার ৯৮১টি আবেদন ছিল ভুয়া। কারণ আবেদনপত্রের সঙ্গে মূল আবেদনপত্রের স্বাক্ষরের (১০ বছর আগে দেওয়া গ্রাহকের স্বাক্ষর) কোনো মিল নেই। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এভাবে মোট পাঁচ হাজার ৮০৩ ভারি ১৩ আনা স্বর্ণ প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে। জুয়েলারি সমিতির মূল্য তালিকা অনুযায়ী ওই সময় সেসব স্বর্ণের মূল্য ছিল ৩১ কোটি ৪৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

চার্জশিট না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। এটা আমার ক্যারিয়ারের বিষয়। কে বা কার একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অথচ অনিয়মের বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। দুদক এখন তদন্ত করছে। আশা করছি, এ অনিয়মে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাবে না। কারণ আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ। আমাকে হেয় করতে স্বার্থান্বেষী একটি মহল চক্রান্ত করছে

মহিউদ্দিন আহমেদ মহি, চেয়ারম্যান, সমবায় ব্যাংক

শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, ঢাকাতেও স্বর্ণ জালিয়াতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা অংশে ভুয়া স্বাক্ষর ও নকল পরিচয়পত্র দিয়ে মোট ৪৫৫টি আবেদন করেন গ্রাহকরা। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ১২০ জন সঠিক গ্রাহককে স্বর্ণ ফেরত দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩৩৫টি আবেদন ভুয়া হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। এভাবে ঢাকা থেকে মোট ৩৩৫ গ্রাহকের এক হাজার ৫৯৪ ভরি ১৪ আনা স্বর্ণ আত্মসাৎ করেছে চেয়ারম্যান চক্র। গড়ে ১৮ ক্যারেট হিসেবে প্রতি ভরি ৫৪ হাজার ১৮০ টাকা ধরে মোট আট কোটি ৬৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন তারা।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধান কার্যালয়, ঢাকা

দায়িত্বশীল সূত্র আরও জানায়, জালিয়াতির ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ব্যাংকের দুটি বিভাগ। একটি স্বর্ণ বিভাগ ও অপরটি হিসাব বিভাগ। সমবায় আইন অনুযায়ী বিভাগীয় সার্বিক কাজের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধান সংশ্লিষ্ট বিভাগের ডিজিএম বা উপ-মহাব্যবস্থাপকের ওপর বর্তায়। তারা কোনো সমস্যায় পড়লে জিএম বা চেয়ারম্যান বরাবর লিখিত চিঠি দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু স্বর্ণ আত্মসাতের ঘটনা দুদক পর্যন্ত গড়ালেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি ডিজিএম।

এ বিষয়ে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ মাহি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেসব অনিয়ম হয়েছে তার সঙ্গে আমি জড়িত নই। কয়েকজন কর্মকর্তা এসব অনিয়ম করেছেন। বিষয়টি প্রথমে আমি জানতাম না। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চেয়ারম্যান হিসেবে আমার জানার কথা নয়। কারণ স্বর্ণে নিলাম বা বিক্রির বিষয়গুলো ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা দেখে থাকেন। চেয়ারম্যান পর্যন্ত ওইসব ফাইল আসে না। পরে যখন আমি জানতে পারলাম তখন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। তদন্ত কমিটিও হয়েছিল। দুদকের মামলার কারণে এসব কার্যক্রমে আর গতি আসেনি।

দুদকের মামলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন— জানিয়ে চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, চার্জশিট না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। এটা আমার ক্যারিয়ারের বিষয়। কে বা কার একটি অভিযোগের ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অথচ অনিয়মের বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। দুদক এখন তদন্ত করছে। আশা করছি, এ অনিয়মে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাবে না। কারণ আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ। আমাকে হেয় করতে স্বার্থান্বেষী একটি মহল চক্রান্ত করছে বলেও জানান মহিউদ্দিন মাহি।

এসআই/এমএআর/