স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

স্বপ্নেরও স্বপ্ন আছে! তবে সেই স্বপ্নের পরিধিটা অনেক বড়। স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে স্থান পাওয়ার। দেশের জনপ্রিয় সুপারশপগুলোর অন্যতম একটি স্বপ্ন, যারা গ্রামের কৃষক থেকে নগরের মধ্যবিত্তের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। যে স্বপ্নগুলো দেখেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষক, তা বাস্তবায়ন এবং তুলনামূলক কম মূল্যে ক্রেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার স্বপ্ন নিয়ই মাঠে নেমেছিল এসিআইয়ের স্বপ্ন সুপারশপ (এসিআই লজিস্টিকস লিমিটেড)।

স্বপ্নের দীর্ঘ সময়ের পথ চলা, নিত্যনতুন পরিকল্পনা, ক্রেতাদের আস্থা অর্জন,ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাসহ সার্বিক বিষয় জানাতে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন স্বপ্নের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবু সালেহ সায়াদাত।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্নতে আপনি যোগদান করার পর অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে, সফলতা এসেছে, সেটার পেছনের গল্প জানতে চাই।

সাব্বির হাসান নাসির : স্বপ্নের পুরো টিম একযোগে কাজ করেছে নিজেদের সর্বোচ্চ দিয়ে। স্বপ্নের ইকোসিস্টেম, বিজনেস ইউনিট, ক্রেতা সবার কাছেই স্বপ্নের একটি গ্রহণযোগ্যতা প্রথমে আমরা সৃষ্টি করতে পেরেছিলাম। ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ, যা আমরা শেষ পর্যন্ত করতে পেরেছি।

একসময় ক্রেতাদের স্বপ্ন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নেগেটিভ ছিল। এছাড়া এসিআইয়ের ইকোসিস্টেম থেকেও নেগেটিভ ইম্প্রেশন ছিল। বলতে বাধা নেই, একসময় স্বপ্নের গ্রহণযোগ্যতা কম ছিল। পরবর্তীতে স্বপ্নের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রথমত আমরা বেসিক জিনিসটা ঠিক করার চেষ্টা করেছি। সমস্যাগুলো ধরে ধরে আমরা কাজ করি সবসময়। এ বিষয়ে আমারা খুবই সচেতন, যা আমাদের অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্নকে এগিয়ে নিতে পরবর্তীতে আর কী কী করলেন?

সাব্বির হাসান নাসির :  প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল আমরা বড় লোকের সুপার শপ বানাতে চাই না। আমরা স্বপ্নকে আপামর জনসাধারণের সুপারমার্কেট হিসেবে নিয়ে যেতে চাই। তাদের কীভাবে সুপার শপে নিয়ে আসা যায় এবং তাদের জন্য পণ্যর প্রাইস কীভাবে রিজেনেবল করা যায়, সে বিষয় নিয়ে আমরা বারবার আলোচনা করেছি।

প্রাইসকে রিজেনেবল করার জন্য সোর্স থেকে সবজি, মাছ কিনেছি। গরুর মাংস, চিনি, চালের মার্কেট চেনা, বোঝার চেষ্টা করেছি। এগুলোর জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে আমাদের। এ রকম কাজ করতে করতে এমন একটা অবস্থানে গিয়েছি যখন সাধারণ ক্রেতারা ভাবছেন স্বপ্নতে আসা যায়। এই আসা যায় কাজটা করতেই আমাদের অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই লক্ষ্য রেখেছি কাস্টমার সার্ভিস, কাস্টমারদের কাছ থেকেই তাদের সমস্যা, তাদের চাহিদার কথা জানতে চেয়েছি। আমাদের টার্গেট ছিল আমরা কাস্টমারদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত শিখব। যে কারণে আমরা কাস্টমারের সাথে সাথে হেঁটে আমাদের স্টোর গুলোকে আজ বড় করতে পেরেছি।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্নকে নিয়ে বর্তমান পরিকল্পনা কী? কাস্টমারদের জন্য নতুন কোনো সেবা আসছে?

সাব্বির হাসান নাসির : গ্রহণযোগ্যতার পরিসর আরও বৃদ্ধি করতে আমরা কাজ করতে চাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের সব জায়গায় থাকবে স্বপ্ন, এটা নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি। আমরা আরও নতুন কিছু সার্ভিস আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই। প্রায় ৬০০টির মতো প্রাইভেট লেবেল ব্র্যান্ড আছে। আমাদের নিজস্ব প্রোডাক্ট আমরা বাড়াতে কাজ করছি। আমরা ফুড সেফটি নিয়ে প্রচুর কাজ করেছি। এ ব্যাপারে ‍কৃষক ভাইদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে ইউএসএইডের সঙ্গে কাজ করেছি। আমাদের দেশটা কৃষকের দেশ। আমরা আলটিমেটলি হয় কৃষকের সন্তান, নয়ত কৃষকের নাতি। আমরা আমাদের সেলস অ্যাসোসিয়েট, বিক্রয় সহযোগী, কর্মী কাস্টমারদের ডিল করে, তাদের নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমরা মাটির মানুষ যারা, তাদের প্রায়োরিটি দিই, যেন তারা আমাদের ক্রেতাদের সম্মান করেন, বুঝতে পারে তাদের।

ঢাকা পোস্ট : ফোনে ফোনে বাজার অনেক জনপ্রিয়, সেই সাথে সাপ্তাহিক ডিসকাউন্ট অফারগুলোতে কেমন সাড়া পান?

সাব্বির হাসান নাসির : ফোনে ফোনে বাজারের কনসেপ্টটাতে আমরা খুব সাড়া পাই। ইয়াং জেনারেশন ছাড়া কিন্তু অন্যরা অ্যাপ বা ওয়েবসাইটে তেমন একটা অভ্যস্ত নন। কোভিডের সময় যে কারণে ফোনে ফোনে একটা বাজারের কনসেপ্ট আমরা নিয়ে এসেছিলাম। এটা ব্যবহার করে ক্রেতারা অর্ডার করছেন, ভিডিও করে দেখছেন, সেই বাজার আমরা পৌঁছে দিচ্ছি তাদের বাসায়। ক্রেতা আমাদের একজনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে অর্ডার কনফার্ম করছেন। ক্রেতাও মনে করছেন যে উনি কথা বলে বলে আলাদা আলাদা পণ্যর অর্ডার করতে পারছেন নিজে নিজে। তারা পরিবেশটা পাচ্ছেন অনেকটা ফিজিক্যালি উপস্থিতির মতই।

এছাড়া সাপ্তাহিক একটা ডিসকাউন্ট সার্ভিস সবাই পছন্দ করে। সেই জায়গাটাতে আমরা কাজ করছি। উইকেন্ড ডিসকাউন্ট এটা সব দেশেই আছে। এটা সবাই পছন্দ করে। এ রকম সাপ্তাহিক ডিসকাউন্ট অফার আমাদের ক্রেতাদের স্বস্তি দেয়, আগ্রহ বাড়ায়। যেসব পণ্যের দাম নিয়ে মানুষ দুশ্চিন্তায় আছে, সেটার মূল্যের ব্যাপারে বেশি বেশি উদ্ভাবন করার চেষ্টা করি। অন্যরা যখন কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, গণমানুষের কষ্টের কথা ভেবে স্বপ্ন সে জিনিসের দাম কমিয়ে দেয়। আলু নিয়ে যখন ক্রাইসিস, ডিম, পেঁয়াজ নিয়ে যখন ক্রাইসিস, সবাই যখন দাম বাড়িয়েছে, তখন কিন্তু আমরা এগুলোর দাম কমিয়ে দিয়েছি। আমারা সবসময় খুঁজে দেখি এখন মানুষ কী নিয়ে টেনশনে আছে, কোন জিনিসের দাম বেশি নিয়ে মানুষ চিন্তিত। সেই জিনিসেরই দাম আমরা কমানোর চেষ্টা করি।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্ন অপারেটিং প্রফিটে আসার পর আপনারা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন ?

সাব্বির হাসান নাসির : আমারা এখানে প্রচুর বিনিয়োগ করেছি। প্রথম দিকে সে তুলনায় রিটার্ন আসেনি। অপারেটিং প্রফিটে আমরা এসেছি। আমরা এখন আন্তঃকোম্পানির দেনা শোধ করতে চাই। এছাড়া বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য নতুন নতুন আরও স্টোর খোলার মাধ্যমে পুঞ্জীভূত লোকসান কমিয়ে আনা। সেই জন্য ক্রেতার পরিধি আরও বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্ন কাস্টমারদের কাছে একটি প্রিয় ব্র্যান্ড এখন, এটাকে প্রিয় বানাতে অনেক কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে...

সাব্বির হাসান নাসির : স্বপ্ন গণমানুষ বিশেষজ্ঞ, মধ্যবিত্তের চাহিদা গভীরভাবে বোঝার চেষ্টা করে। যদিও স্বপ্ন সব শ্রেণির ক্রেতাদের জন্য কেনাকাটার উপযুক্ত স্থান। সবার কথা বিবেচনায় রেখে আমরা কাজ করি। আমরা অনেকগুলো ইউনিক স্টোর ডিজাইন করেছি, আধুনিক সব ডিজাইনগুলো নিয়ে এসেছি, আমাদের শপগুলোতে কাস্টমারদের আস্থা ভালোলাগা আরও বেড়েছে। আপনি লাভ করেন, আর লস করেন, আপনার আউটলেটের পরিবেশটা ঠিক রাখতে হবে। স্বপ্নকে সুপার মার্কেট হিসেবে মর্যাদা দান করার জন্য প্রাথমিকভাবে যা যা করা দরকার আমরা প্রথমে সেগুলোই করেছি। এসবের জন্য প্রতিটা কর্মচারী কর্মকর্তাকে ধরে ধরে আমরা আলাদাভাবে ট্রেনিং দিয়েছি। প্রথমদিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সপ্তাহে কমপক্ষে দুইবার করে শপগুলো ভিজিট করেছি। অ্যাসোসিয়েটদের (আমরা স্বপ্নযোদ্ধা বলি) সঙ্গে কথা বলেছি, শিখিয়েছি।

কাস্টমার যখন বলেছে এটার দাম এত বেশি কেন? তখন আমরা সেটার দাম কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকের স্বপ্নকে তৈরি করেছেন ক্রেতা সাধারণ। যে কারণে এখানে প্রতিদিন এক লাখের মত ইনভয়েস হয়। লাখের বেশি কাস্টমার প্রতিদিন ঢুকে এবং কেনাকাটা করে। এটা তো আর একদিনে হয়নি। এটা আমাদের সবার চেষ্টার ফলে দিনে দিনে অনেক সময় ধরে তৈরি হয়েছে। সাধারণ ক্রেতারা আজ স্বপ্নকে নিজেদের মনে করেছেন।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছে, লিডার হিসেবে অনুভূতি কেমন?

সাব্বির হাসান নাসির : যেকোনো পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতিটাই অন্য রকমের। অ্যাওয়ার্ড আমাদের সবার জন্যই খুব গর্বের। এশিয়ার টপ মার্কেটিং কোম্পানি অব দ্যা ইয়ার হিসেবে আমরা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। সুপার মার্কেট ক্যাটাগরিতে টানা সাতবার সেরা সুপারস্টোর ব্র্যান্ড হিসেবে এবং টানা ৪ বছর সারা দেশের সেরা ১০টি ব্র্যান্ডের একটি হিসেবে সম্মানিত হয় ‘স্বপ্ন’। এছাড়া ষষ্ঠ এশিয়া মার্কেটিং এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড জিতেছে, কানস লায়নস ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভাল অব ক্রিয়েটিভিসি উৎসবে বেশ কয়েকটি ক্যাটাগরিতে পদক জিতেছে স্বপ্ন। সব মিলিয়ে এগুলো আমাদের সবার জন্য গর্বের।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্ন অটিজম এবং তৃতীয় লিঙ্গের জন্য কর্মসংস্থান করেছে, যা রিটেইল সেক্টরে প্রথম, এই চিন্তাটা কীভাবে আসলো?

সাব্বির হাসান নাসির : যেখানেই মানুষের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়, সেখানেই আমরা পাশে দাঁড়াতে চাই। সে ক্ষেত্রে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের জন্য আমরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া বিশেষ চাহিদার মানুষ সমাজে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। তাদের মধ্যে অনেক রকমের গুণ আছে, যা অন্য স্বাভাবিক অনেক মানুষদের মধ্যে নেই। গড গিফটেড কিছু আলাদা গুণ। তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা খুব সুন্দর গান করেন, দুর্দান্ত ছবি আঁকেন। এটা গিফটেড পাওয়ার যা অন্যদের থাকে না। তাদের স্বপ্ন কখনও যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত না হয়, তাই স্বপ্ন সবসময় তাদের পাশে দাঁড়াতে চায়। সে কারণে আমরা তাদের নিয়ে এসে এখানে কাজে লাগাতে চেয়েছি। তারা তাদের স্বপ্নকে যেন লালন করতে পারে, তাদের যেন লক্ষ্য থাকে। সে কারণেই তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের পাশে দাঁড়াতে ভালো লাগে, ভালো লাগে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে। যেখানেই মানুষের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয় সেখানেই স্বপ্ন দাঁড়াতে চায়।

ঢাকা পোস্ট : স্বপ্ন নিয়ে স্বপ্নের কথা বলুন।

সাব্বির হাসান নাসির : স্বপ্নকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে যাওয়া, আর সে অনুযায়ী কাজ করে চলেছি, আগামীতেও করতে চাই। আমরা চাই স্বপ্ন একটি সবচেয়ে বড় পরিসরের সুপারশপে রূপান্তরিত হোক। দেশের প্রতিটি প্রান্তে, এমনকি দেশের বাইরেও স্বপ্ন থাকুক। কৃষকের আস্থার জায়গা হোক স্বপ্ন, বিশ্বাসের জায়গা হোক স্বপ্ন। ই-কমার্স, হোম ডেলিভারি একটা মডার্ন রূপে যাক স্বপ্ন। কৃষক এবং মধ্যবিত্ত ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ সেতুটি আরও সুদৃঢ় হোক স্বপ্নে।

ঢাকা পোস্ট : শেষ কথায়, মোটা দাগে বলতে গেলে, স্বপ্নকে কোথায় দেখতে চান ?

সাব্বির হাসান নাসির : স্বপ্নকে গণমানুষের হৃদয়ে দেখতে চাই।

ঢাকা পোস্ট : আপনাকে ধন্যবাদ।

সাব্বির হাসান নাসির : আপনাকেও ধন্যবাদ।

এএসএস/এসকেডি