টাকার প্রতীকী ছবি

বিদেশে পাচার করা সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনাসহ মানিলন্ডারিং বিষয়ে সার্বিক কর্মকাণ্ড ঠিক করতে জরুরি বৈঠক ডেকেছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স। আগামী বুধবার (৩০ ডিসেম্বর) বিকেলে অ্যাটর্নি জেনারেলের সভাপতিত্বে এ বিষয়ে একটি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব ও  বিএঅফআইইউ এর ডেপুটি হেড মো. ইস্কাদার মিয়ার স্বাক্ষর করা এক চিঠির মাধ্যমে এ তথ্য জানা গেছে। সভায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।

দুদক ও এনবিআরের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সভায় বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ ও এগুলো পর্যালোচনা করে করণীয় এবং বর্তমান কর্মকাণ্ডের অগ্রগতি বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে টাস্কফোর্স সভার বিষয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দুদক ও এনবিআরসহ সূত্রে আরো জানা গেছে, বিগত পাঁচ বছরে বিভিন্ন সংস্থার কাছে অর্থপাচার সংক্রান্ত প্রায় সাড়ে ৩ হাজার সুনির্দিষ্ট প্রতিবেদন জমা হয়েছে। এসব অভিযোগ তদন্তে কাজ করছে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচটি সংস্থা। সংস্থাগুলো হলো- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে গত ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দুদকসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে একটি পর্যবেক্ষণ দেন। এ সময় তদন্তের অগ্রগতি জানাতে সংস্থাগুলোকে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এর আগে হাইকোর্ট গত ২২ নভেম্বর ৫টি সংস্থাকে লিখিত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণমূলক বক্তব্য ছিল- বিদেশে অর্থ পাচারকারীরা দেশের শত্রু। যারা দেশের টাকায় লেখাপড়া করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিদেশে অর্থপাচার করছে, তারা কখনো দেশের বন্ধু হতে পারে না। তারা জাতির সাথে বেঈমানি করছে।

হাইকোর্টের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতেই টাস্কফোর্সে এ সভা ডাকার সিদ্ধান্ত হয় বলেও জানা গেছে।

২০১১ সালে চোরাচালান প্রতিরোধে গঠিত আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স বাতিল করে বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনতে সরকার ২০১৩ সালে নতুন টাস্কফোর্স গঠন করেছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অব বাংলাদেশকে আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালককে সদস্য সচিব করে ৯টি সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে এ টাস্কফোর্স গঠিত হয়।

২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করার ঘটনা দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত করে থাকে। আর বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থ বিদেশে পাচারের ঘটনা তদন্ত করে এনবিআর। এছাড়াও হুন্ডি বা অন্য কোনো উপায়ে অর্থ পাচার হলে তা পুলিশের সিআইডি বিভাগ তদন্ত করে।

অর্থপাচার ঠেকাতে বাংলাদেশে ২০১২ সালে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন করা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর এ আইন সংশোধন করা হয়। আইন অনুযায়ী, বৈধ বা অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বা সম্পত্তি নিয়মবহির্ভূতভাবে বিদেশে পাচার মানিলন্ডারিং অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়।

মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে অর্থ বা সম্পত্তি পাচার হিসেবে যেসব বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে, আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দেশের বাইরে সম্পত্তি বা অর্থ প্রেরণ বা রক্ষণ, দেশের বাইরের যে অর্থ-সম্পত্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে এবং যা বাংলাদেশে আনয়নযোগ্য ছিল, তা আনা থেকে বিরত থাকা, বিদেশ থেকে প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা বা বিদেশে প্রকৃত দেনার অতিরিক্ত পরিশোধ করা ইত্যাদি।

মানিলন্ডারিং অপরাধের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন চার বছর ও সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণ ও সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডও করা হতে পারে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অর্থ পাচার নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। জিএফআইয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানি ও রফতানির মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়।

এদিকে বিদেশে পাচার করা এসব অর্থ ফেরত আনতে বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার নজিরও রয়েছে। ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংকে থাকা আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকারও বেশি অর্থ দেশে ফেরত আনতে সক্ষম হয় দুদক।

অর্থপাচারের রহস্য উদঘাটন ও আইনি কার্যক্রম বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মোজাম্মেল হক খান বলেন, অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দুদকের অবস্থান সবসময়ই কঠোর। এ ঘটনা উদঘাটন ও শাস্তি সুনিশ্চিত করতে দুদকের মানিলন্ডারিং ও গোয়েন্দা ইউনিট রয়েছে। বেশকিছু আর্থিক অপরাধ প্রমাণে দুদক দেশের বাইরে তথ্যের খোঁজে চিঠি দিয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।

আরএম/এমএইচএস