আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী ব্যাংকের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ঋণের মান বিবেচনায় নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকগুলো তার মুনাফা কিংবা শেয়ারহোল্ডারদের মূলধন থেকে  চাহিদা মতো সঞ্চিতি সংরক্ষণ করে। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য বলছে, সরকারি-বেসরকারি নয় ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের ঘাটতির পরিমাণ ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণসংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে সরকারি তিন ব্যাংক এবং বেসরকারি ছয় ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, অগ্রণী ও  রূপালী ব্যাংক। বেসরকারি খাতের বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক।

খাত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যাংক ব্যবসা করে আমানতকারীদের জমানো অর্থ দিয়ে। ব্যাংক যেসব ঋণ বিতরণ করে ওই ঋণের গুণগত মান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ব্যাংকের ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দঋণে (খেলাপি) পরিণত হলে পরবর্তীতে যেন আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, এজন্যই প্রভিশন রাখার বিধান রয়েছে। এখন কোনো ব্যাংকে প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।

বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ  আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শত ভাগ

আরও পড়ুন

এক সময় কোনো ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি থাকলে শুধু সতর্ক ও ঘাটতি মেটাতে দিকনির্দেশনা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোনো ব্যাংকে টানা দুই বছর ঘাটতি থাকলে তার বড় অঙ্কের জরিমানাসহ লাইসেন্স বাতিলের কথা বলা আছে। এসব কারণে নানা উপায়ে প্রভিশন ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো।

নীতি অনুযায়ী, বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ব্যাংকগুলো তাদের নিয়মিত বা অশ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে পরিচালন মুনাফার ০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত, ‘সাব স্ট্যান্ডার্ড’ বা নিম্নমানের শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ এবং ‘ডাউটফুল’ বা সন্দেহজনক শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ  আর ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হয় শত ভাগ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, বাণিজ্যিক ২৮টি ব্যাংক কোনোমতে এ অর্থ রাখতে পেরেছে। অর্থাৎ এসব ব্যাংকের নিরাপত্তা সঞ্চিতিতে কোনো ঘাটতি নেই, উদ্বৃত্তও নেই। সরকারি-বেসরকারি ওই নয় ব্যাংক নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে। বাকি ব্যাংকগুলোতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি উদ্বৃত্ত আছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে সরকারি বেসিক ব্যাংকের। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এরপরই চার হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। তাদের ঘাটতি চার হাজার ১৯৮ কোটি টাকা।

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি বা মন্দ ঋণ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২০৯ কোটি টাকা যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।  অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১৬ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা বা ২৪ শতাংশ এবং রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ৭০ শতাংশ অর্থাৎ আট হাজার ৭২৮ কোটি টাকা।

রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে সরকারি বেসিক ব্যাংকের। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। এরপরই চার হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঘাটতি নিয়ে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী ব্যাংক। তাদের ঘাটতি চার হাজার ১৯৮ কোটি টাকা

প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক। নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় আর্থিকভাবে দুর্বল থেকে অতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটির। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশন প্রয়োজন ছিল ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র এক হাজার ৮৮৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাখতে পেরেছে। ফলে ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি।

এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মেহমুদ হোসেনের সঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রভিশন ঘাটতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৫৪২ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে ঢাকা ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৩৯৯ কোটি টাকা। চতুর্থ অবস্থানে এনসিসি ব্যাংক। ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি ৩৩৫ কোটি টাকা। পঞ্চম অবস্থানে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। তাদের ঘাটতি  ২৩৪ কোটি টাকা।

প্রভিশন ঘাটতির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক। নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় আর্থিকভাবে দুর্বল থেকে অতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকটির। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকটির মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৫১৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশন প্রয়োজন ছিল ১৫ হাজার ৬৮১ কোটি ৮১ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি মাত্র এক হাজার ৮৮৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা রাখতে পেরেছে। ফলে ১৩ হাজার ৭৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি

নতুন করে প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে চতুর্থ প্রজন্মের মধুমতি ব্যাংক। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৯১ কোটি ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি রেখেছে ১৯০ কোটি ২৩ লাখ টাকা। তাদের ঘাটতি ৯০ লাখ টাকা।

প্রভিশন ঘাটতি প্রসঙ্গে অর্থনীতির বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলো প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। ব্যাংকগুলো নিয়ম বহির্ভূত ঋণ দিয়েছে। এ কারণে এখন এসব ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে পারছে না। এটা ব্যাংকের জন্য ভালো খবর নয়। যেহেতু আমানতকারীদের অর্থের সুরক্ষায় প্রভিশন রাখতে হয়, সুতরাং এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার কঠোর হওয়া উচিত।’

‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেয় বাস্তবে তার চেয়ে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। তাই পুরো তথ্য প্রকাশের পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। কারণ, খেলাপি না কমলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে না’— জানান এ অর্থনীতিবিদ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের (২০২৩ সাল) সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ ঋণখেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা। গত ছয় মাসে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) বেড়েছে ২৩  হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। নয় মাসে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর) বেড়েছে ৩৪ হাজার ৭৪১ কোটি টাকা। আর এক বছরে (সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২৩) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা।

চলতি বছরের জুনে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা। মার্চে ছিল এক লাখ ৩১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা; যা ওই সময়ের মোট ঋণের ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

চলতি বছরের (২০২৩ সাল) সেপ্টেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলো মোট ঋণ বিতরণ করেছে ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ ঋণখেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ পর্যন্ত সহনীয়

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে এক লাখ ছয় হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। তবে, সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮১ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। এর মানে, প্রয়োজনের তুলনায় ২৫ হাজার ২৭১ কোটি টাকা সামগ্রিক ঘাটতি হয়েছে। জুনে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। এর মানে, তিন মাসে তিন হাজার ৪০৭ কোটি টাকা সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে।

এ ছাড়া, কোনো কোনো ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেওয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম।  

এসআই/এমএআর/