স্মার্ট অর্থনীতি বিনির্মাণে এসএমইদের (দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প) প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) ডিসিসিআই অডিটোরিয়ামে ‘স্মার্ট এসএমইদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি’ বিষয়ক সেমিনারে ডিসিসিআই সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার এসব কথা বলেন। জিবিএল ফিনটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুর রহমান সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক প্রাক্তন মুখ্য সমন্বয়ক এবং সাবেক মুখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) চেয়ারম্যান মুহ. মাহবুবর রহমান ওই সেমিনারে যথাক্রমে বিশেষ অতিথি ও সম্মানিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।  

ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মো. সামীর সাত্তার বলেন, দেশের এসএমইদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো, সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় সংস্কার বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভবিষ্যতে স্মার্ট অর্থনীতিতে রূপান্তরে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাকে বেগবান করার পাশাপাশি বিশেষ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে স্থানীয় এসএমইরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

তিনি জানান, আমাদের ৯ মিলিয়ন এসএমই উদ্যোক্তা কৃষি, পণ্য উৎপাদনসহ ব্যবসায়ের বিভিন্ন খাতে প্রায় ২৪.৫ মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেছে এবং জিডিপিতে তাদের অবদান প্রায় ২৫ শতাংশ। এসএমইদের প্রযুক্তি বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি, তথ্য-প্রযুক্তি গ্রহণে স্বল্পসুদে পুনঃঅর্থায়ন সহায়তা প্রদান, ফিনটেক ব্যবস্থার সর্বাত্মক ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, টেকনোলজি ট্রান্সফার, কর ও শুল্ক বিষয়ক সহায়তা প্রদান, নীতি সহায়তা প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোরারোপ করেন ডিসিসিআই সভাপতি।  

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে স্মার্ট সরকারের পাশাপাশি স্মার্ট ইকোনোমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সরকারের সংস্থাগুলো প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে জনগণের ভোগান্তি ও ব্যয় কমবে এবং সেবার মান বৃদ্ধি পাবে। এসএমই খাতে যথাযথ তথ্য প্রাপ্তির বিষয়টি এখাতের সম্প্রসারণে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের একান্ত অপরিহার্য।

তিনি বলেন, এসএমই উদ্যোক্তারা আমাদের অর্থনীতি ও জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি হারে অবদান রেখে আসছে, তাই তাদের উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই।      

সাবেক মুখ্য ও অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাথাপিছু আয়, জ্বালানি সক্ষমতাসহ অন্যান্য সূচকে আমাদের উন্নয়ন হয়েছে এবং এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে দেশের বেসরকারিখাত। 

তিনি বলেন, আমাদের এসএমই উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি সাহসী এবং নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের তথ্য-প্রযুক্তিখাতে সক্ষমতা বাড়ানো গেলে, অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনায়ন সম্ভব। প্রযুক্তি গ্রহণে আমাদের মধ্যকার ভয়-ভীতি দূরীকরণের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি আরও বলেন, সরকারি-বেসরকারিখাতের যৌথ সমন্বয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।    

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) চেয়ারম্যান মাহবুবর রহমান বলেন, সারা দেশে আমাদের ৮৫টি কার্যালয় ও প্রায় ১০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম রয়েছে, যেখানে থেকে এসএমই উদ্যোক্তাদের ৫ শতাংশ হারে ঋণ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের দক্ষতা উন্নয়নে বিসিক নানাবিধ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে বলে তিনি অবহিত করেন।  

তিনি বলেন, ‘এন্টারপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট’ এবং ‘গ্লোবাল ইনোভেশন’ সূচকে বাংলাদেশ যথাক্রমে ৮৪ ও ১০৫তম স্থানে রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার, আর্থিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা এবং দক্ষতার অভাব আমাদের এসএমই খাতের উন্নয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা।

মাহবুবর রহমান বলেন, উচ্চ কর ও শুল্ক হার, টেকনোলোজি বিষয়ক ‘নো-হাউ’ পিছিয়ে থাকা, সক্ষমতার অভাব, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের উচ্চমূল্য, তথ্য সুরক্ষা, সাইবার সিকিউরিটি এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রভৃতি বিষয়সমূহ আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জ  তৈরি করছে। আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ‘স্মার্ট এসএমই’ তে রূপান্তরের লক্ষ্যে নীতিমালার সংস্কার ও সহায়ক নতুন নীতিমালা প্রণয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। 

এছাড়াও এসএমইদের সহজশর্তে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির পরিবেশ উন্নয়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।  

সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় সেবা প্ল্যাটফর্ম লিমিটেডের কো-ফাউন্ডার ইলমুল হক সজীব, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলোজির অধ্যাপক ড. বি মাইনুল হাসান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বক্তব্য রাখেন।  

ইলমুল হক সজীব বলেন, আমাদের এসএমইদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়া এখন সময়ের দাবি এবং দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু হয়েছে, এমতাবস্থায় ডিজিটাল পেমেন্ট ইকোসিস্টেমে অংশগ্রহণ বাড়াতে এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসকল্পে তিনি সবার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ওপর জোরারোপ করেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাইনুল হোসেন বলেন, পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবে আমরা অনেক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি না, বিশেষকরে এসএমইদের সার্বিক উন্নয়নে এখাতে একটি ডাটাবেজ একান্ত আবশ্যক।

তিনি বলেন, মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বেশ ভালো করেছে এবং দেশে ই-কমার্স খাতের আরও বিকাশে ‘ক্রস-বর্ডার ট্রেড’ সম্প্রসারণের আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে যুগোপযোগী ও সহায়ক নীতিসহায়তা একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মেসবাহ উল হক সারা দেশে ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়নের জোরোরোপ করেন। সেই সঙ্গে প্রযুক্তিগুলোর সর্বাত্মক ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

মুক্ত আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এসএমই বিভাগের জয়েন্ট ডিরেক্টর জাহিদ ইকবাল বলেন, এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৯০০ কোটি টাকার একটি ফান্ড রয়েছে এবং শুধুমাত্র প্রডাক্ট, সার্ভিস, প্রসেস এবং টেকনোলজি প্রভৃতি খাতে নতুনত্ব নিয়ে আসতে পারলে মাত্র ৪ শতাংশ হারে ওই ফান্ড থেকে ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। এছাড়া অন্যান্য আলোচকরা এসএমইদের ঋণের সুদের হার কমানো ও ঋণপ্রাপ্তির শর্তাবলি সহজিকরণ, সরকারি সংস্থাসমূহের মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধি, এসএমই বিষয়ক আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন এবং কর ও শুল্ক বিষয়ক সহায়ক নীতিমালা দেওয়ার ওপর জোরারোপ করেন। 

ডিসিসিআই সহ-সভাপতি এস এম গোলাম ফারুক আলমগীর (আরমান), সহ-সভাপতি জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এবং তথ্য-প্রযুক্তিখাতের উদ্যোক্তারা এ অনুষ্ঠানে অংশ নেন।  

আরএম/এসএম