দেশের সাধারণ মানুষ যখন পণ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির জাঁতাকলে পিষ্ট, অর্থনীতিতে চলছে সংকট, তখনো আয় কমেনি অনেকের। বরং তাদের আয় বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুুযায়ী গত এক বছরে দেশের ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ৭ হাজার!

সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোতে কোটি টাকার উপরে রয়েছে এমন হিসাবের সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টি।

সোমবার ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে উঠে আসে কোটি টাকার হিসাবের এ সংখ্যা।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নানা সংকট আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জাঁতাকলে পিষ্ট নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। সাধারণ মানুষ সংসারের ব্যয় মেটাতে পারছেন না। ছোট ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে পারছে না। ব্যাংকে টাকা জমানো তো দূরের কথা, অনেকে আগের জমানো অর্থ ভেঙে খাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতেও এক শ্রেণির মানুষের আয় বেড়েছে, যা সমাজে বৈষম্যের প্রতিফলন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে। তারপরও অনেক সাধারণ মানুষের এমন হিসাব বাড়ছে, এটা সত্য।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার ৬৮৪টি। এসব হিসাবে জমা আছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা রয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ৫৮৬টি। এসব হিসাবে জমা আছে ৭ লাখ ২৫ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ৪২ দশমিক ৩৫ শতাংশ কোটি টাকার হিসাবধারীদের।
 
এ বছর জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৫৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৯২টি। এসব হিসাবে জমা ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার ২৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে এমন ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এই হিসেবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার হিসাব বেড়েছে ৩২টি।

এক বছরের ব্যবধানে মোট হিসাব বেড়েছে ৭ হাজার ৬৬টি। এক বছর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে কোটি টাকার হিসাব ছিল এক লাখ ৬ হাজার ৫২০টি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ঢাকা পোস্ট‌কে ব‌লেন, অর্থনী‌তির নানা সংক‌টের কার‌ণে এখন আমান‌তের প্রবৃ‌দ্ধি অ‌নেক কম। তার মা‌নে মানুষ এখন ব্যাং‌কে টাকা কম রাখ‌ছে। কো‌টিপতিরাও কম রাখ‌ছে। এর ম‌ধ্যে আবার ব্যাংকে আমান‌তের সুদহার কম, ব্যাং‌কে টাকা রাখ‌লে ট্যাক্স কা‌টে। নির্বাচনে টাকার প্র‌য়োজন। একই স‌ঙ্গে ডলা‌রের দাম বে‌শি। অ‌নেকে ডলার কি‌নে রাখ‌ছে। সম্প্র‌তি দেখা যা‌চ্ছে জ‌মি ও ফ্লা‌টের দামও বে‌ড়ে গে‌ছে। এর মা‌নে বিত্তশালীরা জ‌মি-ফ্লা‌টে বি‌নি‌য়োগ কর‌ছে। সা‌র্বিকভা‌বে বল‌তে গে‌লে এসব কার‌ণে কো‌টিপ‌তি‌দের আমানত বাড়ার হার সম্প্রতি কিছুটা কম। এর মধ্যেও কোটি টাকার হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানে সম্পদ আছে মুষ্টিমেয় মানুষের হাতে। অর্থনীতি স্বাভাবিক থাকলে এটা হওয়ার কথা নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর হিসাব সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯ হাজার ৭৬০টি। যেখানে জমা ছিল এক লাখ ৮৭ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি ১ টাকা থেকে ১০ কোটির ১২ হাজার ২২১টি হিসাবে জমার পরিমাণ ৮৬ হাজার ৩১২ কোটি টাকা।

এছাড়া ১০ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার হিসাবের সংখ্যা রয়েছে চার হাজার ৭৪টি, ১৫ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে এক হাজার ৯৬৮টি, ২০ কোটি থেকে ২৫ কোটির মধ্যে এক হাজার ২৭৪টি, ২৫ কোটি থেকে ৩০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৯১৯টি আমানতকারীর হিসাব।

আর ৩০ কোটি থেকে ৩৫ কোটি টাকার মধ্যে ৫১২টি এবং ৩৫ কোটি থেকে ৪০ কোটির মধ্যে রয়েছে ৩৪৩টি, ৪০ কোটি থেকে ৫০ কোটি টাকার হিসাব সংখ্যা ৭৪৭টি। তাছাড়া ৫০ কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা হিসাবের সংখ্যা এক হাজার ৭৭৮টি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।

২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এ আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর বেড়ে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬ টিতে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।

এসআই/এমএ