জাল টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) ব্যবহার করে বিলাসবহুল শতাধিক গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ও আয়কর ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। যেখানে বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ারের মতো বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে। 

একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট কৌশলে বছরের পর বছর ধরে এমন কর্মকাণ্ড চালিয়েছে আসছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দা প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর রাজস্ব ফাঁকি এবং জালিয়াতির এমন অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ও এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে দুদক।

এর আগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের তদন্তেও এমন অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে। সেখানেও ১২৬টি গাড়ির খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে জাল টিআইএন ব্যবহার করে রেজিস্ট্রেশন নেওয়া হয়েছিল।

এনবিআর চেয়ারম্যানকে লেখা দুদকের চিঠিতে বলা হয়েছে, জমা হওয়া অভিযোগ শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে মানিলন্ডারিং কার্যক্রম সংঘটন সংক্রান্ত। মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা-২০১৯ অনুযায়ী অভিযোগটির আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণের এখতিয়ার এনবিআরের। সে কারণে অভিযোগের ওপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, জাল টিআইএনে দামি গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। গাড়ি আমদানিকারক থেকে শুরু করে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-দালালদের তৈরি করা এ চক্রের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলে। ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করা হয়।

বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরযানের সংখ্যা ৫৭ লাখ ৫২ হাজার ১৯৭টি। যেখান থেকে ১ হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে এনবিআরের কর জরিপ অঞ্চল। যাচাই-বাছাইকালে জাল টিআইএন ব্যবহার করে শতাধিক গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করার প্রমাণ মিলেছে। এসব গাড়ির মালিকরা আয়কর বিভাগে নিবন্ধিত করদাতা নন। অনিবন্ধিত ও জাল টিআইএনধারী গাড়ির মালিকদের আয়কর নথি না থাকায় বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে। আবার ব্যক্তিগত বা পরিবহনের জন্য গাড়ি কিনেছেন কিন্তু আয়কর ফাইলে ওই তথ্য দেখাননি, কিংবা দেখালেও কম মূল্য দেখিয়েছেন এমন অভিযোগও রয়েছে।

এ বিষয়ে নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদক থেকে পাঠানো চিঠি পেয়েছি। এনবিআরও এ বিষয়টি নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ করছে। তবে দুদকের ওই চিঠি পাওয়ায় বাড়তি কিছু তথ্য পাওয়া গেল। আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যেহেতু পুরো বিষয়টি এনবিআর সংশ্লিষ্ট তাই দুদক থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এসেছে।

সাধারণত আয়কর অধ্যাদেশে জাল টিআইএন ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর ওপর আর্থিক জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১২৪-এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের টিআইএন অথবা জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা আয়কর আইন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে টিআইএন ব্যবহার বাধ্যতামূলক, সেসব ক্ষেত্রে জাল টিআইএন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে।

অন্যদিকে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেবা দেওয়ার সময় টিআইএন ভেরিফিকেশন না করলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪এএ ধারা অনুযায়ী সেবা প্রদানকালে টিআইএন সনদ যাচাই না করলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে আয়কর বিভাগ।

১৬৫এ ধারা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যক্তি জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা অন্যের টিআইএন ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিআরটিএ’র নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়। আবেদন ও সংযুক্ত দলিলগুলো যাচাই-বাছাই করে সঠিক পেলে গ্রাহককে রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিতে বিআরটিএ থেকে অ্যাসেসমেন্ট স্লিপ দেওয়া হয়। ফি জমা হওয়ার পর পরিদর্শনের জন্য গাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়ে হাজির করতে হয়। গাড়ি পরিদর্শনের পর মালিকানা ও গাড়ি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বিআরটিএ ইনফরমেশন সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) রেজিস্ট্রেশনের অনুমোদন দেন।

রেজিস্ট্রেশনের নম্বর উল্লেখ করে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ট্যাক্স টোকেন প্রিন্ট করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরসহ গ্রাহককে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই টিআইএন সার্টিফিকেট ও অগ্রিম/অনুমিত আয়কর প্রদানের প্রমাণপত্রও লাগে।

এর আগে ২০২১ সালে জাল টিআইএনে পৌনে পাঁচ লাখেরও বেশি গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের (নিবন্ধন) বিষয়টি শনাক্ত হয়েছিল। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএ) ও এনবিআরের সংঘবদ্ধ চক্র এমন অপকর্ম করেছে। এরপর টনক নড়ে উভয় সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের। দফায় দফায় বৈঠক করে জাল টিআইএন’র তৎপরতা বন্ধে টিআইএন সার্ভারের সঙ্গে বিআরটিএ সিস্টেম ইন্টিগ্রেশনের কাজ শুরু করে।

আরএম/এসএম