ওয়েবিনারে অর্থনীতিবিদরা

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দা ও করোনাভাইরাস মহামারি উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে ফিরে যেতে হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।

শনিবার (১৭ এপ্রিল) বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত ‘শিল্পায়ন : শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শিরোনামে ওয়েবিনারে এ মত দেন তারা। ওয়েবিনার সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন, সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামালউদ্দিন আহমেদ।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের সদ্য প্রকাশিত ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গবেষণা গ্রন্থটির বিষয়বস্তু ঘিরে ১৩ সিরিজের আলোচনা সভার ষষ্ঠ পর্ব এ ওয়েবিনার।

সেমিনারে ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকসের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিক-উজ জামান এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন খান অংশ নেন।

সভায় অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, এক সময় বাংলাদেশের ময়মনসিংহ থেকে কলকাতা পর্যন্ত রেললাইন করা হয়েছিল কেবল পাট পরিবহনের জন্য, মানুষের জন্য নয়। আবুল বারকাত তার বইয়ে যে কথাটা বলেছেন, আমি তার সঙ্গে একমত যে প্রাকৃতিক সম্পদে সবারই সমান মালিকানা থাকবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ পরিস্থিতি এড়াতে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে আমাদের ফিরে যেতে হবে।

স্বাধীনতার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পায়নের বৈষম্য তুলে ধরে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ওই সময়ের মিল মালিকরা ছিলেন সবাই পশ্চিম পাকিস্তানের। আমাদের পাটচাষীরা দাম পেতো কম। এই শোষণ ও সম্পদ বণ্টনে বৈষম্য আবুল বারকাতের বইয়ে উল্লেখ আছে।

অধ্যাপক ড. শফিক-উজ জামান বলেন, প্রকৃতির বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে কার্ল মার্ক্সের একটা কথা আছে, আমরা কখনও প্রকৃতিকে জয় করতে পারবো না। প্রকৃতিকে জয় করলে তার ক্ষতি হবে বরং প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। আজ করোনাভাইরাসের প্রকোপে আমরা যখন ঘরবন্দি তখন মার্ক্সের এ কথাটা অনেক প্রাসঙ্গিক। 

তিনি বলেন, আগে পাট ছিল আমাদের শিল্পায়নের মাধ্যম, কিন্তু আশির দশকের শেষদিক থেকে পোশাকশিল্প হয়ে গেল আমাদের শিল্পায়নের মূল মাধ্যম। এটা সঠিক যে এ খাতটি নারীদের জন্য ব্যাপক আত্মকর্মসংস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু আজ নদী দূষণের পেছনে শিল্পকারখানা ও তার বর্জ্য ভূমিকা রাখছে, মিঠা পানি ও উর্বর ভূমি ধ্বংস হচ্ছে প্লাস্টিকে।

কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের সুবিধাগুলো উল্লেখ করে অধ্যাপক শফিক-উজ জামান বলেন, এতে কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। কৃষক আরও টাকা পাবে। কৃষকের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। মনে রাখতে হবে কৃষক একইসঙ্গে উৎপাদক ও শিল্পপণ্যের ক্রেতা।

তিনি বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান একসঙ্গে চলে না। শ্রমিক ছাঁটাই না করে কীভাবে উৎপাদন বাড়ানো যায় তা ভাবতে হবে। অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণ, বৈচিত্র্যপূর্ণ কৃষিপণ্য তৈরি ও কৃষি গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

অধ্যাপক আবুল বারকাতকে ‘প্রথাবিরোধী অর্থনীতিবিদ’ উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ গ্রন্থে তিনি নিজস্ব ভূমি উত্থিত চিন্তাভাবনা গ্রন্থিত করেছেন। তিনি দেশের বর্তমান শিল্পায়নকে বিপর্যয়কর শিল্পায়ন বলেছেনএবং কল্যাণ শিল্পায়ন গঠনের কথা বলেছেন। এর জন্য ১৫টি সুপারিশ করেছেন তিনি, এর মধ্যে প্রথম সুপারিশ হলো মানবায়ন যা মানুষকে তার বাস্তু থেকে কখনও উৎখাত করবে না।  

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবুল বারকাতের ২০ বছরের গবেষণার ফসল ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র : ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইটি যৌথভাবে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ও মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনা। ৭১৬ পৃষ্ঠার এ বইটির জন্য অভিনন্দনবাণী দিয়েছেন ভাষাবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও সমাজ সমালোচক অধ্যাপক নোয়াম চমস্কি।

আরএম/আরএইচ