সামনে ঈদুল ফিতর। এই উৎসবকে ঘিরেই জমজমাট হয়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্য। রোজার মাসখানেক আগে থেকেই পাইকারি ব্যবসা জমতে শুরু করে। তবে ১ থেকে ১০ রমজান পর্যন্ত পাইকারি বাজারে চলে ভরা মৌসুম। গত বছর করোনাভাইরাসের কারণে ব্যবসা বন্ধ ছিল। ফলে অনেক ব্যবসায়ীর লোকসান গুনতে হয়েছে।

এবার তা কাটিয়ে ভালো ব্যবসায়ের আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পাইকারি জুতার দোকানিরা। কিন্তু মহামারি দ্বিতীয় ঢেউয়ে সেই স্বপ্ন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকায় চলাচলে বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার। বন্ধ রয়েছে দোকানপাট শপিংমল ও মার্কেট। বিক্রির ভরা মৌসুমে ব্যবসা বন্ধ থাকায় বড় লোকসানের আশঙ্কায় পাইকাররা।

রাজধানীর গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকার পাইকারি জুতার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গতবারের লোকসানে ব্যবসার অবস্থা খারাপ। এবারও ব্যবসা শেষ। কারণ ব্যবসার সিজনে দোকান বন্ধ। এখন টিকে থাকাই দায়। এমন অবস্থায় লোকসান কমাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোকানপাট চালু করতে চাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি জুতার বাজার। এর মধ্যে সিটি সুপার মার্কেট, জাকের সুপার মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টার ও সিদ্দিক বাজার সমবায় মার্কেট অন্যতম। এখানে দুই হাজারের বেশি পাইকারি জুতার দোকান রয়েছে। মার্কেটগুলোতে দেশি-বিদেশি সব ধরনের জুতা পাওয়া যায়। তবে দেশের তৈরি জুতা বেশি বিক্রি হয়।

জুতার চাহিদা বছরজুড়ে থাকলেও রোজার ঈদে তা কয়েকগুন বেড়ে যায়। এ চাহিদা মেটাতে রোজার আগে জোর প্রস্তুতি নেয় এখানকার দোকানিরা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জুতা কিনতে মার্কেটগুলোতে ভিড় করেন পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। করোনা সংক্রামণ ঠেকাতে বিধিনিষেধের কারণে গত ১৪ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে দোকানপাট। ফলে ভরা মৌসুমে প্রতিষ্ঠান খুলতে না পারায় অনিশ্চিয়তায় রয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা ট্রেড সেন্টারে আইটি সুজ-এর মালিক পাইকারি ব্যবসায়ী জুয়েল ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোজার প্রথম দিন থেকেই ব্যবসা জমে ওঠে। এখন বেচাকেনার মূল সিজন, কিন্তু দোকান বন্ধ। কি করব কিছুই বুঝতেছি না। শুনেছি আগামী রবি-সোমবারের দিকে দোকান খুলে দেবে। তবে ব্যবসার আসল সময় শেষ। তারপরও খুললে কিছু বিক্রি করতে পারব।

তিনি বলেন, পুরান ঢাকার বিভিন্ন কারখানা থেকে মাল (জুতা) এনে পাইকারি বিক্রি করি। সারা বছর যেসব মাল আনি তার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ টাকা নগদ দেই। বাকি টাকা ঈদের আগে পরিশোধ করি। এভাবেই আমাদের ব্যবসা চলে। গতবছর লস হয়েছে। এখন বাকি থাকা টাকা দিচ্ছে না। আবার আমরাও কারখানার দেনা শোধ করতে পারছি না। গত ঈদে কোনো টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। এবার কিছুটা লস কমাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে গেল।

দোকান বন্ধ থাকলেও খরচ বন্ধ নেই জানিয়ে এ পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, দোকান ভাড়া, গোডাউন ভাড়া, স্টাফদের বেতন, ঘর ভাড়া সব মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা খরচ। কোনো কিছু মাফ হবে না। সবই দিতে হবে। দোকান বন্ধ মানে খরচের পাল্লা ভারি হওয়া।

আড়ং সুজের মালিক ওলিউল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটা দোকানে প্রতি মাসে লাখ টাকা খরচ। গত এক বছরে ১২ লাখ টাকার মতো শুধু খরচই হয়েছে। হিসাব করলে পুরাটাই লস। কারণ ইনকাম হয়নি। আমরা ছোট ব্যবসায়ী, আমাদের বেশি পুঁজি নেই। আমরা আর কতদিন টিকে থাকব। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। পরিস্থিতি আর কিছুদিন এমন থাকলে আমাদেরও ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে।

ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখছেন জুতার পাইকারি ব্যবসায়ী এ বি এম আরিফ বলেন, গত বছর যে ক্ষতি হয়েছে আর ধার-দেনা করেছি, তা পরিশোধ করে কাটিয়ে উঠতেই দুই-তিন বছর লেগে যাবে। ভেবেছিলাম এবার কিছু ব্যবসা হবে। কিন্তু যখন ব্যবসা জমে উঠার কথা তখনই বন্ধ। দেউলিয়া হওয়ার পথে আমরা। সামনের কী অবস্থা হবে কিছুই বুঝতেছি না। এখন দ্রুত দোকানপাট খুলে না দিলে অনেক ব্যবসায়ীর পথে বসতে হবে।

৪০ বছরেও এমন পরিস্থিতির শিকার হননি জানিয়ে কেযার সুজের স্বত্বাধিকারী সবদর আলী ভূঁইয়া বলেন, আগে ভালো মন্দ যাই হতো ব্যবসা সচল ছিল। এখন ব্যবসাই বন্ধ কি করব। রোজার সময় আগে বিশ্রামের নেওয়ার সময় পেতাম না। এখন বাসায় বসে আছি। শুধু আমাদের নয় খুচরা ও উৎপাদনকারী সবার ব্যবসাই বন্ধ। ৭০ লাখ টাকা দেনা হয়ে গেছি। বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে ফেরত দেয় না। আমরা তো এসব করতে পারি না। তাই দেনা নিয়ে মরেও শান্তি পাব না।
 
দোকান বন্ধ করে দেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এ পাইকার বলেন, মহামারি এসেছে। সরকার লকডাউনের নামে দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা কী করব, কর্মচারীরা কি করবে? অনেক কর্মচারী অসহায় হয়ে গেছে। কেউ গ্রামে চলে গেছে। এই চিন্তা কেউ কী করে? দোকান খোলা থাকলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যবসা করতাম। তাহলে কিছুটা ক্ষতি কম হতো। কর্মচারীদের বেতন দিতে পরতাম। আমরা তো সরকারের কাছ থেকে অনুদান না সহযোগিতা চাই।

ঢাকা ট্রেড সেন্টারের এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, শুনেছি সামনে সপ্তাহে দোকান খুলে দেবে। তখন আর কি ব্যবসা করব? কারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা দূরদূরান্ত থেকে এসে মাল (জুতা) নিয়ে বিক্রি করে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসে মাল নিতে দুই-তিন দিন লেগে যায়। এখন সময় কম। সামনে কি হবে পুরাই অনিশ্চিয়তায় আছি।

এসআই/ওএফ