করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক মন্দা, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি এবং দেশি-বিদেশি নীতিগত বিভিন্ন সমস্যার কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে মুষ্টিমেয় কিছু দেশে রপ্তানি-নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি মানসম্পন্ন নতুন পণ্য তৈরি ও রপ্তানির বাজার সম্প্রসারণের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের সমন্বয়ে দেশে ‘স্মার্ট ব্যবসার’ পরিবেশ তৈরি প্রয়োজন বলে মনে করেন তৈরি পোশাক খাতের তরুণ উদ্যোক্তা শাহ্ রাঈদ চৌধুরী।

তরুণ এ উদ্যোক্তা ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক। যুক্তরাষ্ট্রের পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লুবিন স্কুল অব বিজনেস’ থেকে ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। শেখার উদ্দেশ্যে লঙ্কা-বাংলা ফাইন্যান্সে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তার নেওয়া বেশকিছু উদ্যোগ সফলও হয়।

সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘ইভিন্স গ্রুপ’র পরিচালক পদে যোগ দেন। এরপর দেশের লাইফ-স্টাইলের জগতে আনেন নতুন ধারা। মাস্টার ফ্র্যাঞ্চাইজি হিসেবে দেশে আনেন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রিটেইল চেইন ব্র্যান্ড ‘মিনিসো’ ও ‘নয়ের’। যা ইতোমধ্যে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। এরপর তিনি আরেকটি বড় উদ্যোগ নেন ২০২০ সালে। বড় ভাই শাহ্ আদিব চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ পরিবেশবান্ধব গার্মেন্টস কারখানা ‘ইভিটেক্স ড্রেস শার্ট লিমিটেড’। তরুণ এ উদ্যোক্তা ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরীর ছোট ছেলে। বিজিএমইএ’র আসন্ন ২০২৪-২৬ মেয়াদের নির্বাচনে ‘পরিচালক’ পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন শাহ্ রাঈদ চৌধুরী।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক ডিজাইনার রিটেইল ব্র্যান্ড ‘মিনিসো’ এবং রিটেইল ক্লদিং ব্র্যান্ড ‘নয়ের’–এর কর্ণধার এবং ‘লিড প্লাটিনাম’ প্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানা ইভিটেক্স ড্রেস শার্ট লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা রাঈদ চৌধুরী সম্প্রতি খাত-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন দেশের অন্যতম শীর্ষ অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের। কথা হয় তৈরি পোশাক খাতের বর্তমান অবস্থা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, আগামী দিনের সম্ভাবনা এবং আসন্ন বিজিএমইএ নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মো. শফিকুল ইসলাম।

ঢাকা পোস্ট : তৈরি পোশাক খাতের বর্তমান অবস্থা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : তৈরি পোশাক শিল্প দেশের সবচেয়ে বড় খাত। রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। বিশাল কর্মীবাহিনী যেমন এখানে কাজ করছেন, তেমনি বিদেশি বিনিয়োগও এ খাতে সবচেয়ে বেশি। তাই এখানে সংকটও আছে। গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যা আছে, অবকাঠামোগত ও নীতিগত বিভিন্ন সমস্যা আছে। যেহেতু এটা বড় খাত তাই কোনো সমস্যা হলে সংকটও বড় আকার ধারণ করে। বড় খেলোয়াড়ের সমস্যা বড় মাপের হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশের ক্রেতা তাদের পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। এমন সময় রপ্তানিতে সরকার যে হারে নগদ সহায়তা দিয়ে আসছিল সেটাও কমিয়ে দিয়েছে। ফলে নতুন করে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।

ঢাকা পোস্ট : সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারের মাধ্যমে জানিয়েছে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি পণ্যের ওপর সরকারি নগদ প্রণোদনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক গার্মেন্টস মালিক বলছেন— এটি তাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : আমি খুব সহজ ভাষায় এ প্রশ্নের উত্তর দেব। প্রথমত, অনেক কারখানা বেঁচে আছে এ প্রণোদনার ওপর। শুনতে খারাপ শোনা গেলেও এটিই বাস্তবতা। দ্বিতীয়ত, প্রণোদনার বিষয়টি যখন সামনে আসে তখন বিদেশি ক্রেতাও এটি (প্রণোদনা) উল্লেখ করে দাম কমিয়ে দেন। অর্থাৎ প্রণোদনাও তারা (বিদেশি ক্রেতা) দামের মধ্যে ফেলে দেন। তারা যখন আমাদের সঙ্গে পণ্যের দাম নিয়ে দামাদামি করেন তখন বলেন যে, তুমি ওই জায়গা থেকে প্রণোদনা পাচ্ছ। সেজন্য আমাকে ডিসকাউন্ট দাও। প্রাইস আরও কমাও। তাহলে বোঝেন, কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে? প্রণোদনা কমে যাওয়ায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণে আমাদের সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে সার্বিকভাবে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে হচ্ছে।

ঢাকা পোস্ট : এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পোশাক-কারখানার মালিকদের করণীয় কী?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : কোনো খাতের সমস্যা এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়। সামষ্টিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বড় প্লাটফর্ম হিসেবে বিজিএমইএ’র একটা শক্ত অবস্থান থাকতে হবে। এজন্য দক্ষ বোর্ড দরকার। যারা এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন।

বৈশ্বিকভাবে দেখা যায়, এ খাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বর্তমান প্রজন্ম। আমাদের দেশে মাত্র দ্বিতীয় প্রজন্ম এসেছে। ১৯৮৩ সালে টিনশেড দিয়ে কারখানা শুরু করেছিলেন আমার বাবা। এখন সেটির বয়স ৪০ বছর। বিশ্বের ফ্যাশন সেক্টরে যেভাবে পরিবর্তন এসেছে, ক্রেতাদের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। এসব পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে। সিনিয়ররা গাইড করবেন, যুবকরা সামনে দৌড়াবে, কাজ করবে। এ সুযোগটা বড়দেরই করে দিতে হবে।

ঢাকা পোস্ট : আমরা সবসময় শুনি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে পণ্যের দর-কষাকষিতে আমরা পিছিয়ে থাকি, কেন?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : বিদেশি ক্রেতারা কাকে কাজ দেবেন তারাই সেটি নির্ধারণ করেন। কারণ, বাজারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। কোনো কাজ দেওয়ার আগে প্রথমে তারা কোনো গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠান দেখেন না, দেখেন কোন দেশকে কাজটা দেবেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, তাদের হাতে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, চায়না, মিয়ানমারসহ অনেকগুলো বিকল্প দেশ রয়েছে। কাজ দেওয়ার আগে অনেক বিষয় দেখেন তারা। পণ্যের কোয়ালিটি, অর্ডার দিলে কত সময় লাগবে, দাম কেমন হবে, কী কী সুবিধা পাবেন ইত্যাদি। এরপর যখন পণ্যের মান দেখেন তখন তারা মূল্যে ছাড় দেন। আবার যখন মূল্য দেখেন তখন পণ্যের মানে কিছুটা ছাড় দেন।

এখন ক্রেতার চাহিদার ওপর দর-কষাকষি নির্ভর করে। আমাদের সবুজ কারখানা বাড়ছে, এটা ইতিবাচক। এখন চাহিদার বিষয়টিও দেখতে হবে। বিশ্বে বর্তমানে নন-কটন অটোমেশন পণ্যের চাহিদা বেশি। এ খাতে বিনিয়োগ করলে ক্রেতা বেশি আনতে পারব আমরা। যখন আমরা চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারব তখন দর-কষাকষি করতে পরব। নতুন বাজার সম্প্রসারণে এ বিষয়গুলোর ওপর নজর দেওয়া জরুরি।

ঢাকা পোস্ট : বিজিএমইএ’র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৩৫টি পরিচালক পদে দুই প্যানেলে— সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের ৭৯ জন প্রার্থী হয়েছেন। আগামী ৯ মার্চ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আপনিও পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এ খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য আপনার প্রতিশ্রুতি কী থাকবে?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : কোনো খাতে কাজ করতে চাইলে ওই খাতের ওপর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কাজ করার সক্ষমতাও থাকতে হবে। আমি নিজে দুটি ব্র্যান্ড ‘মিনিসো’ ও ‘নয়ের’ প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ব্যবসা করছি। আমার পরিবারের সবাই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কোভিডের আগে দুই ভাই নিজ হাতে গ্রিন ফ্যাক্টরি গড়েছি। আমরা জানার চেষ্টা করেছি একটি কারখানা করতে কতটা পেইন নিতে হয়, আবার বায়ারের চাপটাও বুঝি। এসব অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চাই। যদি বিজিএমইএ’র বোর্ডে আসার সুযোগ পাই তাহলে নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করব। বড়দের অভিজ্ঞতা এবং তারুণ্যের সক্ষমতা সমন্বয় করে ‘স্মার্ট ব্যবসার’ পরিবেশ তৈরি করতে সহযোগিতা করব।  

এবারের নির্বাচনে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকে এসেছেন। আমি তরুণদের প্রতিনিধি হয়ে উৎসাহ দিতে চাই যেন তারাও এখানে আসেন। আমি বিদেশে পড়ালেখা করে দেশে এসেছি। আমার অনেক ভাই-বোন আছেন, যাদের অনেক বড় বড় শিল্পকারখানা রয়েছে। তাদের বলব, আসেন, দেখেন; দেশের পোশাক খাত বিশ্বে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যারা দেশে আসবেন না, বিদেশে থাকবেন; তাদের বলব, বিদেশ থাকেন ঠিক আছে, ওখানে অফিস খোলেন, বায়িং সাইটটা দেখেন। এটাও একটা ফ্যাক্টর। বায়াররা যখন দেখবেন নতুন প্রজন্ম আসছে, তখন তারাও এ দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ দেখাবেন। আমার বিশ্বাস, এ খাত আগামীতে আরও এগিয়ে যাবে।

ঢাকা পোস্ট : ভোটাররা আপনাকে কেন ভোট দেবেন?

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : আমি মনে করি, আমাদের প্যানেলে (ফোরামের প্যানেল) এবার যারা আছেন তারা সবাই পোশাক খাতের বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে অনেক বেশি সক্ষম। আর আমার ব্যাপারে বলব, আমি এসব সমস্যা সমাধানে বদ্ধপরিকর। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের মতো তরুণ প্রজন্মকে যদি সুযোগ করে দেওয়া হয় তাহলে আমরা অনেক ভালো করতে পারব। কারণ, এ খাতে এখনও প্রচুর সময় ও শ্রম দেওয়া সম্ভব। আমাদের রয়েছে তরুণ, শিক্ষিত ও স্মার্ট প্রজন্ম, যারা বেশ সম্ভাবনাময়। দেশকে কিছু দেওয়ার জন্য তারা সর্বদা প্রস্তুত। আমার যেহেতু পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা আছে, যদি নির্বাচিত হই ইনশাআল্লাহ ভালো কিছু করতে পারব।

ঢাকা পোস্ট : ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহ্ রাঈদ চৌধুরী : আপনাকেও ধন্যবাদ। ঢাকা পোস্টের জন্য শুভকামনা।

এসআই/জেডএস