শ‌রিয়াহভিত্তিক বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে চতুর্থ প্রজন্মের পদ্মা ব্যাংক।

বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) এক্সিম ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হ‌বে। এরপর সংশ্লিষ্ট অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদনের পর এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।

একীভূত হওয়ার বিষয়ে জান‌তে চাইলে পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আফজাল করিম ঢাকা পোস্ট‌কে ব‌লেন, এ বিষয়ে আলোচনা হ‌য়ে‌ছে। চূড়ান্ত কিছু হ‌লে আনুষ্ঠা‌নিকভা‌বে জানা‌নো হ‌বে। এর বে‌শি কিছু বলা যা‌বে না।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে জানান, আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে দুর্দশাগ্রস্ত পদ্মা ব্যাংককে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হ‌বে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সং‌শ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, খেলাপি ঋণসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জ‌ড়ি‌ত হ‌য়ে দীর্ঘদিন ধরে দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এমন ডজন খা‌নেকের বেশি ব্যাংক র‌য়ে‌ছে। এসব ব্যাংক এখন দেশের পুরো ব্যাংক খাতের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ি‌য়ে‌ছে। তাই বি‌ভিন্ন দে‌শের ম‌ডেল অনুসরণ করে একীভূতকরণ বা মার্জার করা হ‌বে।

এদি‌কে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে একীভূত (মার্জার) করতে একটি রোডম্যাপ ঠিক করার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকে এক বছর সময় দিয়ে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন’ বা পিসিএ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রক্রিয়ায় ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার, মূলধনের পর্যাপ্ততা, নগদ অর্থের প্রবাহ, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের তথ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আর্থিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচক ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

সেই সূচকে কাঙ্ক্ষিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোকে ‘দুর্বল’ শ্রেণিভুক্ত করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংক টেনে তোলার শেষ পদক্ষেপ হিসেবে অন্য ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিষয়টি আসবে। সরকারও তাতে সায় দিয়েছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো চাইলে স্বেচ্ছায় একীভূত হতে পারবে। এরপর আগামী বছরের মার্চে নীতিমালা অনুযায়ী যারা দুর্বল তালিকায় পড়বে, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ করে কোন পদ্ধতিতে ও কী প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যাংক একীভূত হবে, তা নিয়ে প্রণয়ন করা হবে নীতিমালা। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একীভূত হ‌বে। এক্ষে‌ত্রে আমানতকারীদের সুরক্ষার বিষয়‌টি স‌র্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হ‌বে ব‌লে জানান তি‌নি।

মার্জার কী?

একীভূত বা মার্জার হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা। অর্থাৎ, দুটি কোম্পানি মিলে একটিতে পরিণত হওয়া। সাধারণত সমজাতীয় দুই কোম্পানি বড় কোনো ব্যবসায়িক স্বার্থকে সামনে রেখে একীভূত হয়।

কী পাবে ভালো ব্যাংক?

অধিগ্রহণ করলে দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহক, আমানতকারীর বাজারটি পাবে সবল ব্যাংক। তেমনি দুর্বল ব্যাংকের জনবল, খেলাপি ঋণ, বেনামি ঋণের দায়ও নিতে হবে সবল ব্যাংককে।

ব্যাংক মার্জার নিয়ে ইতিহাস কী বলে

সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই ব্যাংক মার্জারের নজির রয়েছে দেশে। সর্বপ্রথম ব্যাংক একীভূত করার ঘটনা দেখা যায় ১৯৭২ সালে। আর সর্বশেষ ২০০৯ সালে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক (জাতীয়করণ) অধ্যাদেশ, ১৯৭২’-এর ক্ষমতাবলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যরত মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক একীভূত করে নাম দেওয়া হয় রূপালী ব্যাংক। তিন ব্যাংকের সব দায় ও সম্পদ এক করে তৈরি হয় আজকের রূপালী ব্যাংক।

সে সময় রূপালী ব্যাংক ছিল শতভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। ১৯৮৬ সালে এর ৫১ শতাংশ শেয়ার সরকারের কাছে রেখে অবশিষ্ট শেয়ার বাজারে ছেড়ে ব্যাংকটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। বর্তমানে ব্যাংকটির ৯০ শতাংশের বেশি শেয়ার ফের সরকারের মালিকানায় রয়েছে।

১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে শিল্প খাতের বিকাশে ‘বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক’ ও ‘বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা’ নামে দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে ২০০৯ সালের নভেম্বরে প্রতিষ্ঠান দুটিকে একীভূত করে সরকার। নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড।

সাবেক হাবিব ব্যাংক লিমিটেড ও সাবেক কমার্স ব্যাংক লিমিটেড-এর বাংলাদেশে থাকা সব সম্পদ ও দায় সমন্বয় করে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠন করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক।

একই আদেশে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড মিলিয়ে একই বছরে গড়া হয় জনতা ব্যাংক।

সোনালী ব্যাংক গঠন করা হয় তিনটি ব্যাংক নিয়ে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব বাহওয়ালপুর ও প্রিমিয়ার ব্যাংক নিয়ে সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয় একই বছরে।

সুদমুক্ত শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৭ সালের ২০ মে আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৪ সালে মালিকানা পরিবর্তন করে এ ব্যাংকের নাম দেওয়া হয় ওরিয়েন্টাল ব্যাংক।

৬৫০ কোটি টাকার আর্থিক জালিয়াতির কারণে ২০০৬ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক অধিগ্রহণ করে প্রশাসক বসায় বাংলাদেশ ব্যাংক। আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির ৫২ দশমিক ৬৭ শতাংশ শেয়ার উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক মালয়েশিয়ার মালিকানাধীন আইসিবি ফাইন্যান্সিয়াল গ্রুপ হোল্ডিংস এজির কাছে বিক্রি করা হয়।

২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক লিমিটেড রাখা হয়।

এসআই/এনএফ/এসএম