উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির সমন্বয়ে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু সুদহার ও এক্সচেঞ্জ রেট বেঁধে রাখাসহ কিছু ভুল নীতির কারণে দুই বছরের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হ‌য়ে গেল। আগামী‌তে হয়‌তো বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে উদাহরণ হিসেবে পড়ানো হবে, যে একটি ভালো অর্থনীতি মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে কীভাবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল।

এ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় বাস্তবতার আলোকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়ন করার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তা না হলে অর্থনীতিতে যে ভঙ্গুরতা দেখা দিয়েছে, সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তারা বলেন, আগামীতে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা বাণিজ্যে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে।

রোববার (৭ এপ্রিল) রাজধানীর পল্টনে নিজস্ব কার্যালয়ে ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং পরবর্তী বাজেট’ শীর্ষক এক সেমিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান।

সেমিনারে অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, শুধু বাংলাদেশে নয়, বর্তমানে সারাবিশ্বেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যের দিকে সর্বাধিক নজর দেবে সরকার। একইসঙ্গে বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রেখে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বিষয়েও জোর দেওয়া হচ্ছে। বাজেট প্রণয়নের জন্য ইতোমধ্যে বিভিন্ন খাতের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে, আগামীতে আরও হবে। সবার মতামত নিয়ে একটি যৌক্তিক বাজেট দেওয়া হবে। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ডিজিটালাইজেশনে মনোযোগ বাড়ানো হবে।

জ্বালানি তেলের দাম প্রতি মাসে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানে বাড়তি নজর দেবে সরকার।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির সমন্বয়ে সামষ্টিক অর্থনীতি বেশ স্থিতিশীল ছিল। এ অবস্থা থেকে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হলো, প্রবৃদ্ধি স্তিমিত এবং মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না। গত প্রায় ১৮ মাস দুই অংশের কাছাকাছি রয়েছে। পরবর্তীকালে হয়ত বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে উদাহরণ হিসেবে পড়ানো হবে যে কীভাবে একটি ভালো অর্থনীতি মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিতে পরিণত হলো।

এ অবস্থার পরিণতির অন্যতম কারণ হচ্ছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে ভুল নীতি গ্রহণ মন্তব্য করে তিনি বলেন, সে অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি তেলের দাম দুই থেকে আড়াই গুণ বেড়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৭ শতাংশ, পেমেন্ট অব ব্যালেন্সে কোনো সমস্যা ছিল না, মূল্যস্ফীতি নিম্ন পর্যায়ে রেখেই বাজেট দেওয়া হলো। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও ৯-৬ সুদহার ধরে রাখা হলো। টাকাকে শক্তিশালী করে রাখা হলো, অথচ এ পরিস্থিতিতে অর্থনীতিতে কিছুটা সংশোধন আনতে রকেট সায়েন্স জানতে হয় না। অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতেই এটি করার কথা ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। ফলে ক্ষতটা অনেক বেড়ে গেছে। তার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে। সেসময় জন-তুষ্টিমূলক কথাবার্তা না বলে বাস্তবতার  নিরিখে ওই বাজেট প্রণয়ন করা দরকার ছিল। সেটা করা হয়নি। তবে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যেন বাস্তবতার নিরিখে বাজেট প্রণয়ন করা হয়, সরকারকে সেদিকেই মনোযোগ দিতে হবে।

সাবেক অর্থ ও বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় পার করছে। বিশ্বের ন্যায় দেশের অর্থনীতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়ছে। আগে বাজেটে বড় লক্ষ্য ছিল প্রবৃদ্ধি অর্জন, এখন বাস্তবতার নিরিখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নজর দিতে হবে। সরকারিভাবে এটি প্রথম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে।

তিনি বলেন, গত এক বছরে চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে প্রবৃদ্ধিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। কিন্তু বিতরণ বা সরবরাহ পর্যায়ে পিছিয়ে আছে। এ বিষয়টি আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারিনি। ফলে নানারকম অর্থনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে গেছে। এতে বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। আগামী বাজেটে কর আদায়ে বেশি জোর দিতে হবে। যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ধরে রাখার পাশাপাশি বৈষম্য দূর করতে বরাদ্দ বাড়াতে পারলে বেশি কাজে দেবে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, চড়া মূল্যস্ফীতি-উৎপাদনশীলতা হ্রাসের এসময়ে যথাযথ সংস্কার ছাড়া অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, এমন আশা করাটা বোকামি। বাজেটের আগে ঘটা করে ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যার কথা শোনা হয়। তবে এসব সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকরী উদ্যোগ নেয় না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ বিষয়ে আগামী বাজেটে নজর দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ফলপ্রসূ না হলেও এর কারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, আর্থিক খাতে অনিয়মে এক শ্রেণি ইচ্ছেকৃত ঋণ খেলাপি সুবিধা পাচ্ছে। তাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। উল্টো তারা সুবিধা পাচ্ছে। আর আমাদের মতো ব্যবসায়ীরা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করে আবার ঋণ পরিশোধ করছেন। তারা নতুন বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হবেন। কারণ তারা কিছু পান না। আগামী বাজেটে জিএসপি প্লাস ট্রানজিশনের বিষয়ে প্রতিফলন দেখতে চান তারা।

এসআই/এসএসএইচ