মাত্র দুই কোটি টাকা খরচ করে ১০ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহায়তায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একটি বিশেষ টিম অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য ‘ই-রিটার্ন’ সিস্টেম চালু করে। এতে ই-রিটার্ন ব্যবস্থা আগের তুলনায় অনেক সহজ ও করদাতাবান্ধব হওয়ায় দ্রুত জনপ্রিয়তাও পায়।

ই-রিটার্ন সিস্টেমটি মেইনটেন্যান্স, নিরাপত্তা ও আপডেটসহ ই-ট্যাক্স সার্ভিস সেন্টার পরিচালনা এবং আর্থিক-প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাদের (ইইউ) সেই কারিগরি সহায়তার মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হচ্ছে। তবে তার আগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। বরং এনবিআর থেকে প্রকল্পের ব্যয় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসে। ফলে প্রকল্পটি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে ইইউ। এ কারণে সব দায়দায়িত্ব নিতে হচ্ছে এনবিআরকেই।

এ বিষয়ে গত ১৭ এপ্রিল দেশের জনপ্রিয় নিউজপোর্টাল ঢাকা পোস্টে ‘ই-রিটার্ন প্রকল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ইইউ, প্রশ্নবিদ্ধ এনবিআর!’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশ হয়। সেই সংবাদ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে নড়েচড়ে বসে এনবিআর। পদক্ষেপ হিসেবে ইইউ-কে প্রকল্পে রাখতে জরুরি সভার আয়োজন করছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্রথম দফায় মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) ইইউ’র প্রতিনিধির সঙ্গে সভা করেছে এনবিআর। বুধবার (২৪ এপ্রিল) দ্বিতীয় দফায় সভা চলছে বলে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। সভায় এনবিআরের করনীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলমের নেতৃত্বে একটি টিম উপস্থিত রয়েছে। যেখানে এনবিআরের ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা হিসাবে ইরিন আক্তার জুলি দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে ইইউ’র নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইনক্লুসিভ গর্ভনেন্স এনরিকো লরেনজনের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি টিম। বৃহস্পতিবারও (২৫ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত একটি সভা রয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য বদিউল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ই-রিটার্ন সিস্টেমটি মেইনটেন্যান্স, নিরাপত্তা ও আপডেটসহ ই-ট্যাক্স সার্ভিস সেন্টার পরিচালনা এবং আর্থিক-প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। তাদের (ইইউ) সেই কারিগরি সহায়তার মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হচ্ছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে মেয়াদ ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এনবিআর থেকে প্রকল্পের ব্যয় না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল। তবে বৃহত্তর স্বার্থে এনবিআর অন্তত আরও এক বছর প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করছে। আশা করছি ফান্ড জটিলতা কেটে যাবে।

জানা যায়, কর বিভাগে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালুর জন্য এনবিআর ২০১১ সালে ‘স্ট্রেনদেনিং গভর্ন্যান্স ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। প্রকল্পটির আওতায় বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড ট্যাক্স (বাইট্যাক্স) সিস্টেম চালু করা হয়। ভিয়েতনামের এফপিটি ইনফরমেশন সিস্টেম কর্পোরেশন এ সিস্টেম বা সফটওয়্যার তৈরির কাজ করে। যেখানে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে ৫১ কোটি টাকায় কাজটি পায় প্রতিষ্ঠানটি। তারা অনলাইনে রিটার্ন দেওয়ার সফটওয়্যার, করদাতার তথ্যভান্ডার তৈরি করে। ২০১৬ সালে সফটওয়্যারটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলেও প্রক্রিয়াগত জটিলতায় করদাতাদের মধ্যে তেমন সাড়া ফেলতে পারিনি। তার ওপর ভিয়েতনামি প্রতিষ্ঠানটি ২০১৯ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ করে চলে যায়। যাওয়ার আগে তারা এনবিআরকে সফটওয়্যারের কাজ বুঝিয়েও দেয়নি। ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থাটি বন্ধ থাকে। সুতরাং, এখানে এনবিআরের সক্ষমতা বড় একটি প্রশ্ন। সক্ষমতা না বাড়িয়ে ই-রিটার্নে সিস্টেমের পুরো সিস্টেমের দায়িত্ব নিলে জটিলতা দেখা দিয়েছে। 

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করা করদাতার সংখ্যা সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়েছে।

এর আগে এনবিআরের কর ও তথ্য মূল্যায়ন শাখা কিংবা সিস্টেম অ্যানালিস্ট বিভাগ চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে এ সংক্রান্ত চিঠি দেয়। যেখানে বলা হয়, “এনবিআরে চলমান ই-রিটার্ন সিস্টেমের মেইনটেন্যান্স, নিরাপত্তা ও আপডেটসহ ই-ট্যাক্স সার্ভিস সেন্টার পরিচালনা ও প্রচারণার কাজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে ‘ইইউ পিএফএম টিএ’ কর্মসূচির আওতায় অব্যাহত সাপোর্টের মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হয়ে যাবে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘বাংলাদেশে পিএফএম সংস্কার কর্মসূচির কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রযুক্তিগত সহায়তা’ শীর্ষক প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানোর বিষয়ে ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও অনুবিভাগ প্রধানের (ইউরোপ) সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী প্রকল্পের অনুকূলে ব্যয় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে মেয়াদকাল ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বর্ধিত করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যার কার্যবিবরণী এনবিআর চেয়ারম্যানকে প্রেরণ করা হয়েছে। যেহেতু প্রকল্পের অনুকূলে ব্যয় বৃদ্ধি করা হবে না, সেহেতু ইইউ পিএফএম টিএ কর্মসূচির আওতায় তাদের অর্থায়নে চলমান ই-রিটার্ন সিস্টেমের কার্যক্রম চলতি বছরের ৩০ জুনের পর অব্যয়িত ফান্ড দিয়ে বেশিদিন চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে ই-রিটার্ন সিস্টেমটির পরিচালন ব্যয় ও কারিগরি সব ব্যবস্থাপনা এনবিআরের নিজস্ব জনবল দ্বারা পরিচালনার প্রয়োজন হবে।”

চিঠি সূত্রে আরও জানা যায়, যেহেতু চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি সম্পূর্ণ অনিশ্চিত এবং চুক্তি বৃদ্ধি না হলে সিস্টেমটির পরিচালন ব্যয়সহ কারিগরি ও সব ব্যবস্থাপনা এনবিআরের নিজস্ব আইটি ও জনবল দ্বারা পরিচালনার প্রয়োজন হবে। সেহেতু ই-রিটার্ন সিস্টেমটি চলমান রাখা এবং করদাতাদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের জন্য রিটার্ন সিস্টেমটি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান সিনেসিস আইটি লিমিটেডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে টেকনিক্যাল বিষয় বুঝে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইতোমধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে। করদাতাকে নিরবচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের স্বার্থে ওই আইটি প্রতিষ্ঠান হতে সোর্স কোডসহ অন্যান্য সকল টেকনিক্যাল বিষয় বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এনবিআরের সিস্টেম অ্যানালিস্ট বিভাগকে অনুরোধ করেছে কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও মূল্যায়ন শাখা। একইসাথে সময়ে সময়ে ই-রিটার্ন সিস্টেম হস্তান্তরের অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল চিঠিতে।

আরএম/জেডএস