দেশের দুই পুঁজিবাজার

চার ইস্যুতে নতুন প্রত্যাশায় পুঁজিবাজারে আসছেন বিনিয়োগকারীরা। ফলে করোনা মহামারির মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের দুই পুঁজিবাজার। গত বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন বছরের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ব্যাপক উত্থানের মধ্য দিয়ে। তাতে সূচক ও লেনদেনের পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের পুঁজি অর্থাৎ বাজার মূলধনের দিক থেকে ইতিহাসের সেরা জায়গায় অবস্থান করছে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমা কোম্পানিতে বিনিয়োগ হওয়া আড়াই হাজার কোটি টাকার ‘স্মার্ট মানি’ এখন অনান্য সেক্টরে বিনিয়োগ হচ্ছে। নতুন করে পুঁজিবাজারে আরও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ফান্ড আসছে। বেক্সিমকোর মাধ্যমে করোনারভাইরাসের টিকা আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এছাড়াও দেশের পুঁজিবাজার এশিয়ার সেরা পুঁজিবাজারের জায়গা দখল করায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনসহ বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে। তারা নতুন করে বিনিয়োগ করছেন।

অন্যদিকে ব্রোকারেজ হাউজগুলোতে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। ফলে দীর্ঘসময় ধরে আস্থা ও তারল্য সংকটে থাকা পুঁজিবাজার এখন স্থিতিশীল হওয়ার পথে।

তবে বিনিয়োগকারীদের এখন জেনে বুঝে বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। কারণ এখন বিনিয়োগে ঝুঁকি বেশি। এক্ষেত্রে কমিশনকে কারসাজি রোধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জোর দিয়েছেন তারা।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কোম্পানির উদ্যোক্তা-পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ ধারণ এবং ব্যক্তি-পরিচালকদের নূ্ন্যতম ২ শতাংশ শেয়ার ধারণের বিষয়ে কঠোরতার পাশাপাশি বাজারের প্রতি কমিশনের নজরদারি বাড়ানোর ফলে ইতিবাচক ধারায় ফিরছে পুঁজিবাজার।

তিনি বলেন, এখনো আইপিও অনুমোদেনের ক্ষেত্রে সব কিছু ঠিক হচ্ছে না। ভুয়া অডিট রিপোর্টের কোম্পানিকে আইপিওর অনুমোদন না দিয়ে ভালো কোম্পানিকে পুঁজিবাজারে আনার পাশাপাশি পুঁজিবাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইপিওর নতুন পদ্ধতি পুঁজিবাজারের জন্য ইতিবাচক। কমিশনের লটারি তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি ভালো। এতে করে আইপিওতে আবেদনকারী বাড়বে। কারণ আবেদন করলেই সবাই কমবেশি শেয়ার পাবেন। পাশাপাশি প্রতিটি বিও হিসাবে নতুন করে ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ হবে।

ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, কমিশন পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য নতুন নতুন ফান্ড আনার চেষ্টা করছে। ডিমান্ড-সাপ্লালাইয়ের দিক খেয়াল রাখছেন। ফলে নতুন করে বিনিয়োগকারীরাও আসছেন। এভাবে চললে পুঁজিবাজার ভালো থাকবে।

এ প্রসঙ্গে বিএসইসির মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল করতে একদিকে বিনিযোগকারীদের তারল্য বাড়াতে কাজ করছি। অন্যদিকে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ সুরক্ষা দিচ্ছি। তারা সুরক্ষা পেলে বাজারের প্রতি আস্থা বাড়বে।

আগামী ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে একটি শক্তিশালী গতিশীল পুঁজিবাজার উপহার দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

স্মার্ট বিনিয়োগ

গত বছরের সেপ্টেম্বরে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হয়। এবি ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে এই অর্থ বিনিয়োগ হয়। যার অধিকাংশ বিনিয়োগ হয় বীমা কোম্পানিতে। বর্তমানে এই টাকার ৮০-৮৫ শতাংশ অনান্য খাতে বিনিয়োগ হয়েছে। নতুন এই বিনিয়োগের ফলে গত বছরের শেষ দিকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। ব্রোকারেজ হাউজ এবং বিনিয়োগকারীরা এই অর্থকে ‘স্মার্ট মানি’ বা ‘স্মার্ট ইনভেস্ট’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাদের বিনিয়োগ দেখে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এখন নতুন করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করছেন।

করোনার টিকা আসছে

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বেক্সিমকো ফার্মার হাত ধরে বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের টিকা আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ফলে জনজীবন স্বাভাবিক হলে কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা করতে পারবে। অর্থনীতির গতি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা ভালো লভ্যাংশ পাবেন।

আসছে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ

গত ৩১ ডিসেম্বর বিএসইসি আইপিওর পদ্ধতিতে নতুন নিয়ম করা হয়েছে। তাতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর লটারি তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে সব বিনিয়োগকারী আইপিওর শেয়ার পাবেন। তবে তার জন্য একজন বিনিয়োগকারীকে সেকেন্ডারি বাজারে ন্যূনতম ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পাশাপাশি আইপিও আবেদনের ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা চাঁদা নির্ধারণ করেছে। এতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও বাজারসংশ্লিষ্টরা।

সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেড বা সিডিবিএলের হিসাবে, গত ৩১ ডিসেম্বর শেষে পুঁজিবাজারে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাবের সংখ্যা ছিল সাড়ে ২৫ লাখ। এর মধ্যে ৬ লাখ ১৪ হাজার বিও হিসাব কোনো শেয়ার ছিল না। মোট ১৬ লাখ বিওধারী বিভিন্ন সময়ে আইপিওতে আবেদন করেন। তারা যদি ২০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন তবে নতুন করে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আসবে।

কারণ সম্প্রতি বাজারে তালিকাভুক্ত সবচেয়ে বড় মূলধনী কোম্পানি রবি আজিয়াটার আইপিওতে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার বিও হিসাব থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আবেদন করেন। এর মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন আবেদনকারী লটারির পর রবির ৫০০ করে শেয়ার পেয়েছেন। যদি এসব বিনিয়োগকারীর আইপিও আবেদনের আগে তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজে বা সেকেন্ডারি বাজারে ২০ হাজার টাকা করে বিনিয়োগ করতে হতো, তাহলে সেকেন্ডারি বাজারে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আসত।

এশিয়ার সেরা পুঁজিবাজার

উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকে পেছনে ফেলে মহামারীর মধ্যেও বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচক বেড়েছে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ। এশিয়ার মধ্যে সেরা পুঁজিবাজার অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা ব্লুমবর্গের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক এসএন্ডপি বিএসই বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। পাকিস্তানের বাজারের প্রধান সূচক কেএসই অল শেয়ার এর ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের প্রধান বাজার হো চি মিনাহ স্টক ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার সিএসই অল শেয়ার এর সূচক বেড়েছে ৯ দশমিক ৫১ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা স্টক এক্সচেঞ্জ কম্পোজিট এর সূচক কমেছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, মালয়েশিয়ার প্রধান সূচক এফটিএসই বুরসা মালয়েশিয়া কেএলসিআই ৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ, থাইল্যান্ডের প্রধান সূচক সেট কমেছে ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ, ফিলিপাইনের প্রধান সূচক ফিলিপাইনস স্টক এক্সচেঞ্জ পিএসইআই কমেছে ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এতে দেখানো হয়, গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা মহামারির প্রকোপ বাড়ার পর সারাদেশ লকডাউনে যায়। ওই সময় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ৬৬ দিন বন্ধ রাখা হয়। যার ফলে সূচকে ব্যাপক ধস নামে। কিন্তু পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের নেতৃত্বে নতুন কমিশন বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়িয়ে বাজারকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন।

বাজার চিত্র

সর্বশেষ কার্যদিবস রোববার (০৩জানুয়ারি) ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৯২৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। এদিন লেনদেন হওয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে দুইশ’র বেশি কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। ফলে তিন সূচকে পথ চলা ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে ২১৬ পয়েন্ট। প্রায় একই হারে বেড়েছে অন্য দুই সূচক। আর তাতে দিন শেষে বিনিয়োগকারীদের বাজার মূলধন অর্থাৎ পুঁজি বেড়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।

এমআই/এসআরএস