মহামারির ধাক্কায় কমেছে রফতানি আয়। অন্যদিকে আমদানি ব্যয়ও বাড়ছে। যার প্রভাব পড়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যে। বাড়ছে ঘাটতির পরিমাণ। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এক হাজার ৪৪৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। দেশীয় মুদ্রায় ঘাটতির এ পরিমাণ প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার ২২৪ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওপর করা হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে দুই হাজার ৮২৭ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে চার হাজার ২৭৭ কোটি ডলার। সে হিসেবে নয় মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৪৪৯ কোটি ডলার। দেশীয় মুদ্রায় ঘাটতির এ পরিমাণ এক লাখ ২৩ হাজার ২২৪ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ধরে)।

এ সময়ে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ তার আগের বছরের তুলনায় দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ বেশি আয় করেছে। বিপরীতে পণ্য আমদানির ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ৬ দশমকি শূন্য ৪ শতাংশ বেড়েছে। দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিজনিত চাহিদাও বেড়েছে। তাই আমদানি ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বল্প পরিসরে। তবে দেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ চাঙা থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি কম হয়েছে। প্রথম নয় মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহামারিতে পোশাক রফতানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও অন্যান্য খাতের রফাতানি বাড়েনি। অন্যদিকে ওষুধ ও নির্মাণ সামগ্রী, সিমেন্টসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। এসব কারণে আমদানি ও রফতানির মধ্যে ঘাটতি বেড়েছ। তবে সার্বিক দিক চিন্তা করলে এটা খুব খারাপ নয়, কারণ আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ও পাশাপাশি বিদেশি অনেক সংস্থা অর্থ আসছে। 
  
তিনি জানান, আমাদের দেখতে হবে যে আমদানি-রফতানির মধ্যে অর্থ পাচার হচ্ছে কি না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নজরদারি বাড়াতে হবে।

সেবা খাতের ঘাটতি ১৯১৮ মিলিয়ন ডলার
বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাণ করা হয়। করোনাকালীন মানুষ ভ্রমণ কম করেছে। অন্যদিকে আমদান-রফতানি কম হওয়া বিমার খরচও কমে গেছে। ফলে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি কিছুটা কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের নয় মাসে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯১ কোটি ৮০ লাখ ডলার। গত অর্থবছর একই সময়ে তা ছিল ২৩৬ কোটি ডলার।

এফডিআই কমেছে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ
মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাব সরাসরি পড়েছে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) ওপরও। গত অর্থছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ২৪৯ কোটি ১০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। একই সময়ে চলতি অর্থবছরের তা সামান্য বেড়ে ২৫৪ কোটি ৯০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৯৬ শতাংশ কমে ৯৪ কোটি ডলারে নেমেছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১০৩ কোটি ডলার।

চলতি হিসাবে ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স)
এদিকে করোনার মধ্যে বৈশ্বিক অর্থনীতির অবস্থা যখন নাজুক এমন পরিস্থিতিতেও দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) উদ্বৃত্ত বাড়ছে। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে চলতি হিসাবে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। যা আগের অর্থবছরে একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল প্রায় ২৬৫ কোটি ১০ লাখ ডলার।

এদিকে সার্বিক রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কারণে ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ৬৯৯ কোটি ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৬২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এই নয় মাসে ১ হাজার ৮৫৯ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছর একই সময়ে পাঠিয়েছিলেন ১ হাজার ৩৭৭ কোটি ডলার। নয় মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ৩৫ শতাংশ।

দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) গতি কমে নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বিনেয়োগ ছিল তিন কোটি ৯০ লাখ ডলার। এবছর একই সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ২২ কোটি ডলার বেশি চলে গেছে।

এসআই/এসএম/জেএস