প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমদানি ব্যয়। সে অনুযায়ী অর্জিত হচ্ছে না রফতানি আয়। ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে চলছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (গত বছরের জুলাই থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত) দেশের পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি এক হাজার ৭২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার; বাংলাদেশি মুদ্রায় যা এক লাখ ৪৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এছাড়া বহির্বিশ্বের সঙ্গে লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে ভারসাম্যের (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ওপর করা হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

রোববার (৩০ মে) প্রকাশিত হয় প্রতিবেদনটি। এতে উল্লেখ করা হয়, ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ইপিজেডসহ রফতানি খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে তিন হাজার ১৩৩ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ ব্যয় করেছে চার হাজার ৮৫৬ কোটি ডলার। সে হিসাবে ১০ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

আলোচিত সময়ে পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ আগের বছরের তুলনায় আট দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি আয় করেছে। বিপরীতে পণ্য আমদানির ব্যয় আগের বছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশের ভেতরে বিনিয়োগের চাহিদা কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানিজনিত চাহিদাও বেড়েছে। আমদানি বাড়ায় লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে রফতানি বাড়ানো এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ চাঙা থাকায় বাণিজ্য ঘাটতি কম হয়েছে। প্রথম ১০ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ।

করোনাকালে রফতানিতে পোশাক খাত ছাড়া অন্যান্য খাতে তেমন গতি আসেনি

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, মহামারির এ সময়ে রড, সিমেন্টের মতো ভারী শিল্পের ব্যবসা বেড়েছে। ওষুধের চাহিদাও বেড়েছে। এছাড়া তৈরি পোশাকের রফতানিও এখন বাড়ছে। এসব পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। যার কারণে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। তবে রফতানিতে পোশাক ছাড়া অন্যান্য খাতে তেমন গতি আসেনি। ফলে আমদানি ও রফতানির মধ্যে ঘাটতি বাড়ছে। তবে সার্বিক দিক চিন্তা করলে এটা খুব খারাপ নয়। কারণ, আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, পাশাপাশি বিদেশি অনেক সংস্থা থেকে অর্থ আসছে।

তিনি আরও বলেন, আমদানি বাড়ছে মানে শিল্পকারখানার উৎপাদন বাড়ছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এটা অর্থনীতির জন্য ভালো। তবে নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটা হলো, আমদানি-রফতানির মধ্যে অর্থপাচার যেন না হয়।

আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৩২ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে ১৪৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১১১ কোটি ডলার

সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি ১১৪৯ মিলিয়ন ডলার

বীমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়। করোনাকালে মানুষ ভ্রমণ কম করেছে। অন্যদিকে, আমদানি-রফতানি কম হওয়ায় বীমার খরচও কমে গেছে। ফলে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি কম হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে তা ছিল ২২৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি ১৭২২ কোটি ৭০ লাখ ডলার

এফডিআই বেড়েছে ৭.৮৫ শতাংশ

মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ২৭৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ২৯৫ কোটি ৩০ লাখ ডলারে পৌঁছেছে।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে দুই হাজার ৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৮৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১০ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৯ শতাংশ

বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যেটা অবশিষ্ট থাকে সেটাই নিট এফডিআই। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও আগের বছরের চেয়ে ৩২ দশমিক ১৩ শতাংশ বেড়ে ১৪৬ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত বছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ১১১ কোটি ডলার।

চলতি হিসাবে ভারসাম্য

টানা নয় মাস পর বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স) ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৭০ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি আরও বেশি ছিল। ওই সময়ে ঋণাত্মক ছিল প্রায় ৩৭৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে ২০৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা

এদিকে, সার্বিক রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার কারণে ভারসাম্যেও (ওভারঅল ব্যালেন্স) ৭৪৯ কোটি ৮০ লাখ ডলারের বেশি উদ্বৃত্ত ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

চলতি বছরের একই সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ২২ কোটি ডলার বেশি চলে গেছে

চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে দুই হাজার ৬৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল এক হাজার ৪৮৬ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১০ মাসে রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি প্রায় ৩৯ শতাংশ।

অন্যদিকে, দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগের (পোর্টফোলিও ইনভেস্টমেন্ট) গতি কমে নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বিনিয়োগ ছিল তিন কোটি ১০ লাখ ডলার। চলতি বছরের একই সময়ে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ (নিট) যা এসেছিল তার চেয়ে ২২ কোটি ডলার বেশি চলে গেছে।

এসআই/এফআর/এমএআর/