নারীর অগ্রযাত্রায় এসএমই খাত : বাধা পেরিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প
ঘরে বসেই আয়, হাতেই সৃষ্টি। বাংলাদেশি নারী উদ্যোক্তারা এখন শুধু স্বাবলম্বী নন, কর্মসংস্থানও তৈরি করছেন / সংগৃহীত
রংপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে আঁখিমনি। মেধাবী ও স্বপ্নবাজ হলেও তাঁর জীবন শুরু হয় গভীর কষ্টের মধ্য দিয়ে। ছোট বয়সেই বাবাকে হারান। মাত্র ১৩ বছর বয়সে সমাজের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় তাঁকে। দারিদ্র্যের কষাঘাতে যখন চারপাশ অন্ধকার, আঁখি তখনও আলো খুঁজে ফিরেছেন। সংসারের শত ব্যস্ততার মাঝেও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন—সংগ্রামের পথ পাড়ি দিয়ে এসএসসি পাস করেন।
কিন্তু আঁখির স্বপ্ন ছিল আরও বড়। শুধু নিজের জন্য নয়, গ্রামের নারীদের জন্যও কিছু করতে চেয়েছেন তিনি। ঘরের গণ্ডি পেরিয়ে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ নেন, শিখে ফেলেন ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি তৈরির কাজ। নিজের হাতের কাজ দিয়েই গড়তে চেয়েছিলেন একটি স্বপ্নের জগৎ। কিন্তু বাধা ছিল একটাই—অর্থ। পুঁজি না থাকায় বারবার থেমে যাচ্ছিলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
ঠিক তখনই একটি বেসরকারি ব্যাংক পাশে এসে দাঁড়ায়। জামানত ছাড়াই মাত্র ৫ লাখ টাকা ঋণ পান আঁখি। শুরু হয় নতুন পথচলা। কেনেন ৭টি তাঁত মেশিন। তবে কারখানা তৈরি না করে গ্রামের নারীদের ঘরে বসেই কাজ শুরু করান। নারীরা এখন ঘরের কাজের ফাঁকে শতরঞ্জি বুনে আয় করছেন, সম্মান পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
আঁখি আজ শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, অনেক নারীর আশার নাম। তাঁর স্বপ্ন—রংপুরের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যাবে কর্মসংস্থানের আলো। আঁখিমনি প্রমাণ করেছেন, যাদের কিছু নেই, তারাই একদিন অনেক কিছু বদলে দিতে পারেন।
আঁখিমনি’র মতোই স্বপ্নবাজ আরেক নারী রোজিনা বেগম। সিলেটের এক পাহাড়ি গ্রামের এই নারী ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্য ও সমাজের কুসংস্কারের সঙ্গে লড়েছেন। টাকার অভাবে স্কুল ছাড়তে হয়, তবুও থামেননি। বিয়ের পর সংসারের ফাঁকে নিজে নিজে সেলাই শেখেন। ছোট পরিসরে জামা সেলাই শুরু করেন। কাজ ভালো চলছিল, কিন্তু হঠাৎ অর্থাভাবে থেমে যায় সব।
তখন পাশে দাঁড়ায় একটি এনজিও। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ঋণ পান, যেটি দিয়েই আবার শুরু করেন ব্যবসা। গড়ে তোলেন ছোট একটি সেলাই কেন্দ্র, যেখানে এখন কাজ করছেন ১০ জন নারী। যারা একসময় শুধু সংসারের অংশ ছিলেন, আজ তারা উপার্জনক্ষম। রোজিনার বিশ্বাস, যদি সহজে ঋণ পেতেন, তাহলে আরও আগেই স্বাবলম্বী হতে পারতেন। তাঁর স্বপ্ন—গ্রামের সব নারী যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন।
নারীদের উন্নয়নে এসএমই খাত
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে রয়েছে নারীর নীরব শ্রম, আত্মত্যাগ এবং অদম্য স্বপ্ন। একসময় যে নারীরা কেবল ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ ছিলেন, তারা এখন কাজ করছেন কৃষি, তৈরি পোশাক, প্রযুক্তি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা খাতে। এসএমই খাত এখন শুধু অর্থনীতির চালিকাশক্তিই নয়, এটি হয়ে উঠছে নারী উন্নয়নের বড় সুযোগ। কারণ, এই খাতে প্রবেশ সহজ, কম পুঁজিতে শুরু করা যায় এবং ঘরে বসেই আয় করা সম্ভব। গ্রামে-গঞ্জে অনেক নারী নিজের উদ্যোগে সেলাই কেন্দ্র, হস্তশিল্প বা খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন।
এসএমই খাত নারীদের শুধু স্বাবলম্বী করছে না, তৈরি করছে কর্মসংস্থানও। একজন সফল নারী উদ্যোক্তার মাধ্যমে আরও ৫-১০ জন নারী কাজের সুযোগ পান। ফলে বদলে যাচ্ছে পরিবার, এমনকি সমাজও। তবে এখনো বড় বাধা অর্থসংস্থান। সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া, প্রশিক্ষণের সুযোগ, বাজারে প্রবেশের সহায়তা—এসব জায়গায় সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণ বাড়ছে
সময়ের সঙ্গে নারীদের উদ্যোক্তা হওয়ার হার বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশের মোট উদ্যোক্তার ৭.২ শতাংশ নারী; যেখানে ২০১৩ সালে এই হার ছিল মাত্র ৩.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, নারীরা ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যে এগিয়ে আসছেন।
‘নারীর অগ্রযাত্রায় এসএমই’র ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি’—জানিয়ে উইমেন এন্টারপ্রেনার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল বলেন, নারীর জীবনমান উন্নয়নে এসএমই খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় নারীর শ্রম ছিল কেবল গৃহস্থালি কাজেই সীমাবদ্ধ, যার আর্থিক মূল্যায়ন হতো না। এখন তারা পণ্য উৎপাদন, বিপণন ও কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছেন। এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক ও বিভিন্ন ব্যাংকের সহায়তায় তারা নিজেদের তৈরি পণ্য বাজারজাত করতে পারছেন। নারীরা এখন শুধু নিজেরাই স্বাবলম্বী নন, বরং দেশের এসএমই খাতকেও এগিয়ে নিচ্ছেন।
অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৪ অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ এসএমই (ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ) রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৬.৪৭ শতাংশ নারী মালিকানাধীন হলেও নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৭ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১৬.৬৭ শতাংশই নারী, যাঁদের বড় একটি অংশ এসএমই খাতে কাজ করছেন।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ১ লাখ ৬০ হাজার পুরুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে একজন নারীও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাননি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, নারীদের উদ্যোক্তা হওয়া ও আয় করার সুযোগ বাড়ায় তারা পরিবারে টিকে থাকতে পেরেছেন। এটি নারী উন্নয়নের একটি বড় সাফল্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যাংকের কঠিন শর্ত, জামানতের বাধ্যবাধকতা ও নথিপত্রের ঘাটতির কারণে অনেকেই ঋণ পান না। ফলে তারা ব্যবসা শুরু করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২২ সালে ২৫ হাজার কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল তৈরি করে। এ তহবিল থেকে নারীদের ঋণ দিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিলের সুদের হার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের ব্যাংকঋণ পাওয়া সহজ করতে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত ছাড়াই ঋণ দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, এসএমই খাত দেশের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু অনেক ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক উদ্যোক্তা এখনো ব্যাংক ঋণের বাইরে রয়ে গেছেন। জামানত ও কঠিন শর্ত তাদের পথের বড় বাধা। এসএমই খাতে পুনঃঅর্থায়ন তহবিল থাকলেও পুরোটা বিতরণ সম্ভব হয়নি। তহবিলের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোকে এসএমই খাতে বেশি গুরুত্ব দিতে বলেছে। সহজ শর্তে, জামানতবিহীন ঋণের সুযোগ বাড়ানো গেলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন।
এসএমই ফাউন্ডেশন : নারীর পাশে
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী। প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ৫০ হাজারের বেশি উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে, যার বেশিরভাগই নারী। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা প্ল্যাটফর্ম তৈরি, কর্পোরেট ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ এবং ডিজিটাল দক্ষতার প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ নারীদের ব্যবসা পরিচালনায় আরও দক্ষ করে তুলছে। এতে তারা নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনি কর্মসংস্থানও বাড়ছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, নতুন, প্রান্তিক ও নারী উদ্যোক্তারা ব্যাংক ঋণ নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন জামানতের কারণে। এই বাধা অনেকের উদ্যোগ শুরু করার স্বপ্নকে থামিয়ে দেয়। বিশেষ করে যারা গ্রামের বা প্রান্তিক অঞ্চলের, তাদের পক্ষে জামানত দেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণের সুযোগ তৈরি করা জরুরি। তাহলেই তারা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। এসএমই খাতকে এগিয়ে নিতে হলে এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
ই-কমার্সেও নারীর দাপুটে অংশগ্রহণ
বর্তমানে নারীরা শুধু কারখানা বা দোকানেই নয়, অনলাইনেও শক্ত অবস্থান গড়ে তুলছেন। ই-কমার্স ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখন অনলাইনে যারা ব্যবসা করছেন, তাঁদের প্রায় অর্ধেকই নারী। তাঁরা ঘরে বসেই ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মাসে হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন। এতে করে ঘরের কাজের পাশাপাশি আয় করার সুযোগও তৈরি হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "যুগের পরিবর্তনে নারীরা এখন ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। সরকারের উচিত সবার জন্য সহজে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা, যাতে আরও বেশি নারী এই খাতে এগিয়ে আসতে পারেন।"
নারীদের এই অগ্রযাত্রার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবেও পাওয়া যাচ্ছে। ‘মাস্টারকার্ড ইনডেক্স অব উইমেন এন্টারপ্রেনারস ২০২৩’-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বর্তমানে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যায় বিশ্বের ৫৪টি স্বল্প আয়ের দেশের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। দেশে এখন উদ্যোক্তাদের মধ্যে ৩১.৬ শতাংশই নারী। এটি একটি বড় অর্জন, যা বাংলাদেশের নারীর আত্মবিশ্বাস ও সম্ভাবনার প্রতিফলন।
এসএমই খাত এখন আর শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসার সীমায় নেই—এটি হয়ে উঠেছে নারীর ক্ষমতায়নের শক্তিশালী হাতিয়ার। এই খাতে নারীরা শুধু আয় করছেন না, বরং নেতৃত্ব দিচ্ছেন কর্মসংস্থানে, সমাজ পরিবর্তনে এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতায়। নারীর নেতৃত্বে যে আর্থসামাজিক পরিবর্তন আসছে, তার পেছনে এসএমই খাত এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছে।
যদি এসএমই খাতে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা, সহজ নীতিমালা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে নারীদের এই সাফল্য আরও বহু গুণে বাড়বে। এতে দেশের অর্থনীতি হবে আরও শক্তিশালী, টেকসই এবং সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার মতো অন্তর্ভুক্তিমূলক।
এসআই/এমজে