সরকা‌র ঘোষিত ক‌রোনায় ক্ষ‌তিগ্রস্ত কৃষক‌কে ভর্তুকি না দিয়ে উল্টো জোরপূর্বক সুদ আদায় ক‌রে‌ছে। গোপন ক‌রে‌ছে খেলাপি ঋণের তথ্য। দেওয়া হ‌য়ে‌ছে গ্রাহ‌কের ভুল সিআইবি রিপোর্ট। স্থগিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর এবং নতুন ঋণ দিয়ে পুরাতন ঋণ সমন্বয়সহ নানা অনিয়মে জ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছে বি‌শেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)। এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ এক পরিদর্শনে।

জানা গে‌ছে, রাকাবের ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ১২টিতে ২০২০ সালের জুন ভিত্তিক পরিদর্শন পরিচালনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেখা‌নে বেরিয়ে এসেছে রা‌ষ্ট্রের মা‌লিকানা‌ধীন বিশেষায়িত ব্যাংকটির ১৫‌টির মতো গুরুতর অনিয়ম।

বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য বল‌ছে, নির্দিষ্ট কিছু গ্রাহকের ঋণ সংক্রান্ত তথ্য সিআইবি ডাটাবেজে সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এসব গ্রাহকের মধ্যে নওহাট জুট মিলস লিমিটেড, মেসার্স তৌহিদ ট্রেডার্স, মেসার্স পিন্টু এন্টারপ্রাইজ ও পিয়াস ট্রেডিং উল্লেখযোগ্য। ডিপোজিট স্কিমের বিপরীতে যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়, তার সঠিক রিপোর্ট উপস্থাপন করা হয়নি। এর মাধ্যমে প্রভিশন সংরক্ষণে সুবিধা নিয়েছে ব্যাংকটি।

১০ বছরের বেশি সময় ধরে লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু ১১৫টি হিসাবের এক টাকাও জমা করেনি রাকাব। যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সরাসরি লঙ্ঘন

শুধু তা-ই নয়, করোনার সময়ে কৃষকদের ঋণের বিপরীতে সুদের ওপর ভর্তুকি দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত একাধিক সার্কুলার জারি করলেও সেই নির্দেশনা অমান্য করেছে রাকাব। অসংখ্য গ্রাহককে সুদ ভর্তুকি না দিয়ে আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত টাকা। এছাড়া স্থগিত সুদ আয় খাতে স্থানান্তর করেছে রাজশাহীর স্থানীয় মুখ্য কার্যালয়, বাঘা শাখা, জয়পুরহাটের কালাই শাখা ও রংপুরের মিঠাপুকুর শাখা।

এসব শাখার মাধ্যমে ব্যাংকের সার্বিক আয়ের প্রকৃত তথ্য গোপন করা হয়েছে। এরপরও ২০২০ সালে ৬০৩ কোটি টাকার লোকসান দেখিয়েছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত অনুযায়ী লোকসানের অঙ্ক ৬১৭ কোটি টাকা। এ লোকসান পোষাতে দীর্ঘদিন ধরে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে সরকার। ভর্তুকির টাকায় কৃষকের কোনো উপকার না হলেও ফুলেফেঁপে উঠেছেন ব্যাংকটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে আর্থিক সহায়তা হিসেবে বি‌শেষায়িত ব্যাংকটিকে ৫০০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপরও ৮৭৩ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা চেয়েছে রাকাব। মূলধন ঘাটতি, পুঞ্জীভূত লোকসান, খেলাপি ঋণের উচ্চহার ও অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে ডুবতে বসেছে বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। তাই ভর্তুকি দিয়েও লোকসান সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকটি পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশনা দিলেও সেগুলো যথাযথ পরিপালন করতে পারছে না। ফলে রাকাবের সার্বিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে।

করোনার সময়ে কৃষকদের ঋণের বিপরীতে সুদের ওপর ভর্তুকি দেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত একাধিক সার্কুলার জারি করলেও সেই নির্দেশনা অমান্য করেছে রাকাব। অসংখ্য গ্রাহককে সুদ ভর্তুকি না দিয়ে আদায় করা হয়েছে অতিরিক্ত টাকা

পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এক গ্রাহকের কাছে একই দিনে ঋণ সমন্বয় ও বিতরণ করেছে রাকাবের বাঘা শাখা। পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সুদাসলে ঋণের টাকা আদায়ের ক্ষেত্রে ঋণসীমা বৃদ্ধি করে নতুন ঋণ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ঋণের টাকা দিয়ে পুরাতন ঋণ সমন্বয় করা হচ্ছে। এতে ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ব্যাংকের প্রকৃত গ্রাহক অর্থাৎ কৃষকরা। 

রংপুরের মিঠাপুকুর শাখার খেলাপি ঋণ (সিএল বা ক্লাসিফাইড লোন) টপশিট ও ওয়ার্কশিটের মধ্যে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দুই শিটের মধ্যে ৪১ লাখ টাকার অধিক গড়মিল পাওয়া গেছে। এছাড়া ১০ বছরের বেশি সময় ধরে লেনদেনহীন অদাবিকৃত আমানতের টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দেওয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু ১১৫টি হিসাবের এক টাকাও জমা করেনি রাকাব। যা ব্যাংক কোম্পানি আইনের সরাসরি লঙ্ঘন। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের ব্যাপক অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিশেষ পরিদর্শন প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ ব্যাংক

অনিয়‌মের বিষয় রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইসমাইল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘পরিদর্শন বাংলা‌দেশ ব্যাংকের রু‌টিন কাজ। এসব বিষয় নি‌য়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে কথা হ‌য়ে‌ছে। সমস্যাগু‌লোর সমাধানও করা হয়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের (২০২০) জুন পর্যন্ত রাকাবের নিট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮১৬ কোটি টাকা। আগের বছরের (২০১৯) জুন শেষে যার পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি।

গত বছরের (২০২০) জুন পর্যন্ত রাকাবের নিট মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৮১৬ কোটি টাকা। আগের বছরের (২০১৯) জুন শেষে যার পরিমাণ ছিল ২১২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৬০০ কোটি টাকার বেশি

আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। যা ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৩০ শতাংশ। বাড়ছে রাকাবের লোকসানি শাখার সংখ্যাও। ৩৮৩টি শাখার মধ্যে ১১৮টি লোকসানি শাখায় পরিণত হয়েছে।

এদিকে, রাকাবের কিছু কর্মকর্তাকে অবৈধ পদোন্নতির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে আবেদন করেছেন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল হোসেন। চলতি বছরের মে মাসে সিনিয়র সচিব বরাবর চিঠিতে রাকাবের বিভিন্ন গ্রেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদ ছাড়া অন্যান্য সব পদে সরাসরি সাক্ষাৎকার ব্যতীত ২০২০ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক পদোন্নতির আবেদন করেছেন এমডি। যা পদোন্নতি নীতিমালার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

এসআই/এমএআর/