ঘুষের বিনিময়ে গুরুতর অনিয়মে সহায়তাসহ বেশ‌কিছু অ‌ভি‌যো‌গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী এবং এস এম মুনিরুজ্জামান ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সা‌বেক নির্বাহী প‌রিচালক মাহফুজুর রহমানকে ডেকেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি ধরতে গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদ্ঘাটন) কমিটি।

মঙ্গলবার (২২ জুন) দুপুর বাংলা‌দেশ ব্যাং‌কের মি‌নি কনফা‌রেন্স রুম আলাদা আলাদাভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ কর‌ছেন কমিটির প্রধান ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খান। প্রথমে এস কে সুরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে অন্য দুজনকেও ডাকা হবে।

জিজ্ঞাসাবাদ শে‌ষে সা‌বেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী ব‌লেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তুলা হ‌য়েছে তা সবই মিথ্যা। আমার যা বলার তা ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে বলেছি। এরপর তি‌নি দ্রুত গা‌ড়ি‌তে উ‌ঠে বাংলা‌দেশ ব্যাংক থে‌কে চ‌লে যান।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দুর্নীতির স‌ঙ্গে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না দাবি ক‌রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ম. মাহফুজুর রহমান বলেন,  ওই সময় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দায়িত্বে থাকায় আমা‌কে ডাকা হয়েছে। কিন্তু কোনো ধরনের অনিয়মের স‌ঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না।

জানা গেছে, পিপলস লিজিং ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংসহ অন্তত পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন প্রশান্ত কুমার হালদার (পিকে হালদার)। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এসব অর্থ লোপাটের তথ্য চাপা দিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন টিম। এসব অনিয়মের সহায়তা করতো সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। বিনিময়ে পেত আর্থিক সুবিধা। ঘুষের বিনিময়ে এসব অনিয়মে সহায়তা করেছেন আরও বেশকিছু কর্মকর্তা।

পিকে হালদারের অন্যতম সহযোগী ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাশেদুল হকের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রাশেদুল হক।

আদালতে জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো দুই লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর চৌধুরী।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেন, '২০০২ সালের পর থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে যেসব এজিএম-ডিজিএম ছিল, তারা বসে বসে মধু খেত। তাই তারা চুপ থাকত।' এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে 'চোর' ও 'ডাকাত' বলেও উষ্ফ্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।


নিয়ন্ত্রণ সংস্থার শীর্ষ ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে আসা এসব অভিযোগে সমালোচনার ঝড় তুলেন অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা। এর পরই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টনক নড়ে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং (কারণ উদ্ঘাটন) কমিটি গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কমিটিতে ডেপুটি গভর্নর এ কে এম সাজেদুর রহমান খানকে প্রধান ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার হোসেনকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এ কে এম ফজলুর রহমান, ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ডিপার্টমেন্টের মহাব্যবস্থাপক মো. কবির আহাম্মদ, ব্যাংক পরিদর্শন বিভাগ-৪-এর মহাব্যবস্থাপক মো. নুরুল আমীন।

কমিটি গঠনের চান মাস পর হলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। তদন্তে গড়িমসি চলছে এমন অভিযোগ করেছেন অনেকে।

দেশে বর্তমানে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০টির অবস্থা নাজুক। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। এর মধ্যে সাবেক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও সাবেক রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদার একাই ধ্বংস করেছেন চারটি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিং, এফএএস ফাইন্যান্স ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এর মধ্যে পিপলস লিজিং অবসায়নের জন্য অবসায়ক নিয়োগ করা হয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ও বিআইএফসিতে চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন আদালত। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পি কে হালদার লোপাট করেন বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে উঠে আসে। এসব অনিয়মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এসআই/এসএম