সেচ প্রকল্পে ২৪৮ কোটি টাকার নয়ছয়, ১৯ কর্মকর্তাকে তলব
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সেচ বিভাগের অধীনে নেওয়া ‘মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে’ ২৪৮ কোটি টাকা নয়ছয়ের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রকল্প পরিচালনা, ঠিকাদার নিয়োগ থেকে শুরু করে কৃষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়- সবক্ষেত্রেই অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।
দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। কাগজে-কলমে প্রকল্পটির ৭০–৭৫ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কাজের অগ্রগতি খুবই কম বলে জানা গেছে। প্রকল্পের ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি, কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো, কৃষকদের কাছ থেকে ঘুষগ্রহণ, নিন্মমানের কাজ এবং কমিশন বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
অভিযোগের তির বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ আসনের সাবেক এমপি মাহবুব উল আলম হানিফ ও সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের দিকে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুদকের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়ার পর দায়ীদের আইনের আওতায় আনতে প্রকাশ্যে তদন্তের জন্য একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। টিম ইতোমধ্যে নথিপত্র যাচাই-বাছাই শুরু করেছে। এ ছাড়া এর আগে দুদকের এনফোর্সমেন্ট অভিযানেও অনিয়মের প্রাথমিক প্রমাণ মেলে। গত ১৩ জানুয়ারি কুষ্টিয়া দুদক কার্যালয় থেকে পরিচালিত অভিযানে পছন্দমতো ঠিকাদার নিয়োগ এবং সাবেক সংসদ সদস্যদের সম্পৃক্ততার তথ্যও পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া দুদকের অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে। তাদের আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধান কার্যক্রম নিয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেচ প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান টিম কাজ শুরু করেছে। তারা নথিপত্র সংগ্রহ করছে। অভিযোগ-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য ও রেকর্ডপত্র যাচাই শেষে অনুসন্ধান টিম কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে। এরপর কমিশন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) চেয়ারম্যান মো. রুহুল আমিন খান ও জনসংযোগ কর্মকর্তা এম এস সাঈদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুদক যাদের তলব করেছে
অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১৯ কর্মকর্তাকে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদানের অনুরোধ করেছে দুদক। তাদের মধ্যে ২৫ নভেম্বর আসতে বলা হয়েছে বিএডিসির কুষ্টিয়া রিজিয়নের সহকারী প্রকৌশলী এরশাদ আলী ও হাফিজ ফারুক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মমিনুল ইসলাম, আদনান আল বাচ্চু, আসিফ মাহমুদ ও আব্দুল্লাহ আল মামুনকে।
কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে নিষ্কাশন সুবিধাসহ সেচব্যবস্থা উন্নয়ন করতে ‘মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে বিএডিসি। বছরে ৫১ হাজার টন ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ২৪৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়
পরের ধাপে ২৬ নভেম্বর তলব করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গা বিএডিসি’র সহকারী প্রকৌশলী খালেদা ইয়াসমিন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী দিদার-ই-খোদা, আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল হালিম, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও হুমায়ুন কবিরকে।
এর পরদিন ২৭ নভেম্বর আসতে বলা হয়েছে মেহেরপুর বিএডিসির সহকারী প্রকৌশলী শাহজালাল আবেদীন, মাযহারুল ইসলাম ও শাহরিয়ার আহমেদ, উপসহকারী প্রকৌশলী লিমন হোসেন, ইকরামুল হক, শ্যামল হোসেন ও আশরাফুল ইসলামকে।
তাদের প্রত্যেককে নির্ধারিত তারিখে হাজির হয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য চিঠিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগে যা বলা হয়েছে
কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলের প্রায় সাড়ে ২১ হাজার হেক্টর কৃষিজমিতে নিষ্কাশন সুবিধাসহ সেচব্যবস্থা উন্নয়ন করতে ‘মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’ গ্রহণ করে বিএডিসি। বছরে ৫১ হাজার টন ধান, গম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে ২৪৮ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়।
অভিযোগ রয়েছে- কাগজে-কলমে প্রকল্পের অগ্রগতি ৭৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে সিংহভাগ কাজের কোনো অস্তিত্ব নেই। নিজস্ব ঠিকাদার সিন্ডিকেট এবং প্রকল্প পরিচালকের যোগসাজশে কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে প্রকল্পের বড় অংশের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় কৃষক ও সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের মূল কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৩০টি সৌরচালিত ডাগওয়েল নির্মাণ; যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ১২ লাখ টাকা, প্রতি কিলোমিটার ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮০ কিমি খাল পুনঃখনন, ২৫৫টি পাম্প হাউজ নির্মাণ; যার প্রতিটির ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ৯৫টি ২ কিউসেক ফোর্সমোড পাম্প সেট স্থাপন; যার প্রতিটির ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ৫ কিউসেক সোলার পাম্প ২৫টি; যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ১৫ লাখ টাকা, ১৫টি বড় আকারের সেচ অবকাঠামো; যার প্রতিটিতে ব্যয় ৪০ লাখ টাকা, ১২০টি মাঝারি আকারের সেচ অবকাঠামো; যার প্রতিটির ব্যয় ২৫ লাখ টাকা, ৩০০টি ছোট আকারের সেচ অবকাঠামো; যার প্রতিটির ব্যয় সাড়ে ৭ লাখ টাকা এবং ২১৫টি বিদ্যুৎ লাইন নির্মাণ; যার প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ টাকা।
কাজ না করেই ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ অর্থ নেন প্রকল্প পরিচালক এবং ৬০ শতাংশ নেন ঠিকাদার
অভিযোগ রয়েছে, মাঠপর্যায়ে এসব কাজের অনেকটাই হয়নি বা নিম্নমানের হয়েছে। টেন্ডার সিন্ডিকেট, কাগুজে বিল-ভাউচার তৈরি এবং নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বরাদ্দের বড় অংশ আত্মসাৎ করা হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর অঞ্চলে স্থাপন করা দুই শতাধিক সেচ প্লান্টের প্রতিটির জন্য স্থানীয় চাষীদের কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের ঠিকাদার মনোনয়নের ক্ষেত্রে মোট প্রকল্প ব্যয়ের ৫ শতাংশ কমিশন গ্রহণের অভিযোগও উঠেছে প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়া অভিযোগ আছে, কাজ না করেই ভুয়া বিল-ভাউচার দেখিয়ে টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ অর্থ নেন প্রকল্প পরিচালক এবং ৬০ শতাংশ নেন ঠিকাদার।
অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের ডিপিপিতে নির্ধারিত নকশা ও মান অনুযায়ী ছোট, মাঝারি ও বড় আকারের সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি। তাছাড়া ঠিকাদার কাজ শেষ করে বিল তুলতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (২%), সহকারী প্রকৌশলী (১%), সাইট অফিসার (২%) এবং হিসাব সহকারীকে (১%) কমিশন প্রদান বাধ্যতামূলক ছিল বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের এই ঘটনা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্পের অবশিষ্ট অংশ বাস্তবায়নে বরাদ্দ ৫৬ কোটি টাকার কার্যক্রম স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করার দাবিতে প্রকল্প কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধনও করেন স্থানীয়রা।
দুদকের এনফোর্সমেন্ট অভিযান
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকার বিএডিসি কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। এ অভিযানে নেতৃত্ব দেন দুদকের সমন্বিত কুষ্টিয়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল।
অভিযানকালে দেখা যায়, চার বছরে কাগজপত্রে প্রকল্পটির অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৭৫ শতাংশ। ২৪৮ কোটি টাকার প্রকল্পে ইতোমধ্যে ১৯২ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও বাস্তবে তা প্রতিফলিত হয়নি। প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ নয়-ছয় এবং কাজের অস্তিত্বহীনতার কারণে দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম অনুসন্ধানের সুপারিশ করে।
অভিযান শেষে নীলকমল পাল তখন সাংবাদিকদের বলেন, ‘২৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে মুজিবনগর সেচ উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএডিসির কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়েছে। আমরা মাঠপর্যায়েও তদন্ত করব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।’
আরএম/এমএসএ