সাড়ে ১২০০ টাকার সিলিন্ডার ১৮০০, নেপথ্যে কী
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) চলতি ডিসেম্বর মাসের জন্য প্রতি ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম এক হাজার ২৫৩ টাকা নির্ধারণ করলেও রাজধানীর বাজারে এর প্রতিফলন নেই। উল্টো নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
গত কয়েকদিন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে প্রতি সিলিন্ডার এলপিজি ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও ভোক্তাদের সবসময়ই নির্ধারিত দামের চেয়ে কিছুটা বাড়তি খরচ করতে হয়। তবে, এবারের মূল্যবৃদ্ধি পূর্বের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চড়া দামের পাশাপাশি বাজারের বিভিন্ন স্থানে এলপিজি সিলিন্ডারের তীব্র সংকটও দেখা দিয়েছে।
বিজ্ঞাপন
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, শীতকালে স্বাভাবিকভাবে এলপিজির চাহিদা বাড়ে। কিন্তু সেই তুলনায় বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। চাহিদা ও জোগানের এই অসামঞ্জস্যের সুযোগ নিয়ে খুচরা পর্যায়ে দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ ব্যবহারকারীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন
সাড়ে ১২০০ টাকার সিলিন্ডার ১৮০০ টাকা
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে প্রতি মাসে রান্নার জন্য এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হয়। তবে, এবার সিলিন্ডারের আকাশচুম্বী দাম দেখে তিনি বিস্মিত। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সরকার নির্ধারিত দাম এক হাজার ২৫৩ টাকা। পরিবহন খরচ মিলিয়ে বড়জোর ১০০ থেকে ২০০ টাকা বেশি হতে পারে। কিন্তু এ মাসে আমাকে এক হাজার ৭০০ টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছে। বাজারে চলা এই অরাজকতা কবে শেষ হবে?
একই চিত্র দেখা গেছে বনশ্রী এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দা মাহবুব আলম একটি সিলিন্ডার কিনেছেন এক হাজার ৮০০ টাকায়। তিনি জানান, এর চেয়ে কম দামে কোথাও সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। আগে দেখা যেত কিছু কিছু কোম্পানি তুলনামূলক কম দামে গ্যাস দিত, কিন্তু এখন সবারই এক দাম। দামের চেয়েও বড় সমস্যা হলো, অনেক দোকানে এখন সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না।
রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় এখন সিলিন্ডার গ্যাসের উচ্চমূল্য ও সংকটের একই চিত্র। মূলত যাদের বাড়িতে পাইপলাইনে গ্যাসের সংযোগ নেই, তারাই এলপিজির প্রধান গ্রাহক। রান্নাবান্নাসহ প্রতিদিনের জরুরি প্রয়োজনে এই গ্যাসের বিকল্প না থাকায়, বাধ্য হয়ে হাজার-হাজার পরিবারকে নির্ধারিত দামের চেয়ে ৫০০-৬০০ টাকা বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্টে মিলছে না সিলিন্ডার
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পরিবেশক (ডিস্ট্রিবিউশন) পর্যায় থেকে বর্তমানে এলপিজি সিলিন্ডার পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ খুবই সামান্য। এ ছাড়া পাইকারি পর্যায়ে বাড়তি দামে পণ্যটি কিনতে হচ্ছে বলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে খুচরা বাজারে।
মোহাম্মদপুর এলাকার খুচরা বিক্রেতা বজলুর রহমান বলেন, পরিবেশকদের কাছ থেকে সময়মতো সিলিন্ডার পাওয়া যাচ্ছে না। আজ অর্ডার দিলে কয়েকদিন পর সরবরাহ পাওয়া যায়। সরকারি দাম এক হাজার ২৫৩ টাকা হলেও পাইকারি পর্যায়ে কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকারও বেশি দামে। ফলে লোকসান এড়াতে আমাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
বাড়তি মূল্য নিয়ে কথা হয় বনশ্রী এলাকার ‘আইডিয়াল এলপিজি’র স্বত্বাধিকারী ইউসুফ আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, তারা মূলত ডিস্ট্রিবিউশন পয়েন্ট থেকে সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন এবং ওই পয়েন্টগুলো সরাসরি কোম্পানি থেকে গ্যাস আনে।
ইউসুফ আলী বলেন, আমরা এখন পাইকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত সরবরাহ পাচ্ছি না। কোম্পানিগুলো নাকি সাপ্লাই কমিয়ে দিয়েছে। এমনকি বিইআরসি ডিসেম্বর মাসের নতুন দাম ঘোষণা করার পর সরবরাহ আরও কমে গেছে। শীত মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা বাড়ে, কিন্তু সেই তুলনায় সরবরাহ না থাকায় বাজারে এমন তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ডিস্ট্রিবিউশন থেকে আমাদের প্রতিটি ১২ কেজির সিলিন্ডার এক হাজার ৫২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এর সঙ্গে পরিবহন ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে আরও প্রায় ৮০ টাকা খরচ পড়ে। ফলে সবমিলিয়ে এক হাজার ৭০০ টাকার নিচে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। সামনে দাম ও সংকটের মাত্রা আরও বাড়তে পারে।
এলসি জটিলতা-কোম্পানিপর্যায় থেকে দাম বাড়ানোর অভিযোগ
এলপিজি পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল তোশিবা গ্যাস স্টোভের স্বত্বাধিকারী ইকবাল হোসেনের কথায় গ্যাস সংকটের চিত্রটি আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, বেশ কিছু কোম্পানির ডিস্ট্রিবিউশন বর্তমানে প্রায় বন্ধ রয়েছে। আর যাদের সরবরাহ চালু আছে, তারাও চাহিদার তুলনায় অনেক কম গ্যাস দিচ্ছে। সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো এলসি জটিলতার কথা বলছে। সময়মতো এলসি খুলতে না পারায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এলপিজি আমদানি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা জানাচ্ছে।
মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি আরও বলেন, কোম্পানিগুলো প্রতিটি সিলিন্ডারে নির্ধারিত দামের চেয়ে অন্তত ২২০ টাকা করে বেশি রাখছে। পরিবেশক হিসেবে তাদের কাছ থেকে বাড়তি দামেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি, যার প্রভাব সরাসরি খুচরা বাজার ও সাধারণ ভোক্তাদের ওপর পড়ছে।
ট্রেডার পর্যায় থেকে আটকে আছে এলপিজির শিপমেন্ট
দেশের এলপিজি চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণ করে থাকে বেসরকারি কোম্পানিগুলো। এলপিজি আমদানি ও বিপণনের জন্য বর্তমানে ৫৮টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স থাকলেও বাজারে সক্রিয় রয়েছে মাত্র ২৮টির মতো কোম্পানি। এর মধ্যে বসুন্ধরা, যমুনা, বেক্সিমকো, মেঘনা (ফ্রেশ), ওমেরা ও বিএম এলপিজি উল্লেখযোগ্য।
এলপিজি সংকটের বিষয়ে কথা হয় ফ্রেশ এলপি গ্যাসের এরিয়া সেলস ম্যানেজার মো. আফজালের সঙ্গে। তিনি বলেন, এলপিজি মূলত আমদানিনির্ভর একটি পণ্য। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানি কমে যাওয়ার কারণে বাজারে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক কোম্পানির সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত এলসি জটিলতার কারণে সাপ্লাই চেইনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যার ফলে সার্বিকভাবে এলপিজি বাজারে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তবে আমরা আশা করছি, দ্রুত সংকট কেটে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাড়তি মূল্য ও সংকটের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, এলসি খোলা হলেও ট্রেডার পর্যায় থেকে এলপিজির শিপমেন্ট আটকে আছে। কেন আটকে আছে এবং কীভাবে এর দ্রুত সমাধান করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করছি।
এলপিজি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য, ভোগান্তি রোধে প্রয়োজন সরকারি হস্তক্ষেপ
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেইন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলপি গ্যাস বর্তমানে একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ খাতের ভোক্তাদের ভোগান্তির বিষয়টি সেভাবে সামনে আসছে না, কারণ এই সমস্যাটি সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। পাইপলাইনের গ্যাস না থাকলে যেমন দেশজুড়ে হাহাকার তৈরি হয়, এলপিজির ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না। এর প্রধান কারণ হলো, এই খাতের প্রায় পুরোটা এখন বেসরকারি কোম্পানিগুলোর হাতে।
তিনি আরও বলেন, এলসি জটিলতা বা অন্য যেকোনো সমস্যাই হোক না কেন, সরকারকে এখানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি মূলত এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের মাথাব্যথা হওয়া উচিত। কারণ তারা ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে। অতএব সরকারকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে এবং কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। যদি এলসি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তবে তা সমাধানে তড়িৎ সহায়তা দিতে হবে, যাতে দিনশেষে সাধারণ ভোক্তাদের ভোগান্তির শিকার হতে না হয়।
ওএফএ/এমজে