স্থল, নৌ কিংবা আকাশ পথে আমদানি-রফতানিসহ বাণিজ্য সুবিধার বিবেচনায় কাগজে কলমে সারাদেশে ১৮৪ শুল্ক স্টেশন রয়েছে। সরকারি নথিতে এসব শুল্ক স্টেশনের অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে মাত্র ৩৭টি চালু রয়েছে। এছাড়া আরও ৭ শুল্ক স্টেশন চালুর প্রক্রিয়া চলমান।

তবে এমন অনেকগুলো শুল্ক স্টেশন রয়েছে যার অস্ত্বিত্ব কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। এমনকি ভবিষ্যতেও তা চালুর সম্ভাবনা নেই। এবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এরকম ১৩৩ শুল্ক স্টেশন আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করতে যাচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে ১৪০ শুল্ক স্টেশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তবে গত ১৩ অক্টোবর এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের নেতৃত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় সাতটি এলসি স্টেশন তথা শুল্ক স্টেশন বহাল রাখার পক্ষে মতামত আসে। ফলে ওইগুলো বাদ দিয়ে বাকি ১৩৩ স্টেশনকে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় উপস্থিত এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে এ বিষয়ে বলেন, বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকে তালিকাভুক্ত ১৮৪ শুল্ক স্টেশনের মধ্যে যে সব এলসি স্টেশন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ও অদূর ভবিষ্যতে চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে, এমন ১৪০ এলসি স্টেশন তথা শুল্ক স্টেশন প্রজ্ঞাপনে আর না রেখে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মতামত এসেছিল। তবে উপস্থিত ব্যবসায়ী প্রতিনিধিসহ সব অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে প্রেমতলী (গোদাবাড়ি), আরিচাঘাট, মুজিবনগর (বৈদ্যনাথ তলা), রায়মঙ্গল/আংটিহারা, ধামর হাট, আমনুরা রেল স্টেশন ও রাজশাহী বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তাই ৭টি ছাড়া অন্যান্য সব অনুমোদিত এলসি স্টেশন বাতিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে ১৩৩ স্টেশন বিলুপ্ত করার বিষয়ে সবাই একমত হন। যদিও চূড়ান্ত প্রজ্ঞাপনের আগে এমন সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলা যাচ্ছে না। আমদানি-রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান ও প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য (কাস্টমস : নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) জাকিয়া সুলতানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের অংশীজনের আলোচনা হবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বাংলাদেশের স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় দুই হাজার ৪০০ কিমি। যার শতকরা ৯২ ভাগ ভারত এবং বাকি ৮ ভাগ মিয়ানমারের সঙ্গে। দেশের ছোট-বড় ঘোষিত ১৮৪ শুল্ক স্টেশনের অধিকাংশই দুই দেশের সীমান্তবর্তী। এ শুল্ক স্টেশনগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত ও নির্বাচিত স্টেশনে স্থলবন্দর ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ (বাস্থবক)। 

বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমদানি-রফতানির শুল্ক কিংবা চোরাচালান প্রতিরোধে গুরু দায়িত্ব পালনে শুল্কে স্টেশনের জন্ম। যা দায়িত্ব থাকে এনবিআরের কাস্টম বিভাগ। দেশের সক্রিয় ৩৭ শুল্ক স্টেশনের মধ্যে ২৪টি রয়েছে স্থলবন্দরে। যেখান থেকে নিয়মিত ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে-বেনাপোল, তামাবিল, হিলি, সোনামসজিদ, দর্শনা, শেওলা, বুড়িমারী, ছাতক, বিরল, বিবিরবাজার, টেকনাফ, আখাউড়া, জকিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে আমদানি-রফতানি সচল করতে সিলেটের তামাবিল, কুড়িগ্রামের চিলমাড়ি ও শেরপুরের নাকুগাঁওকে আনুষ্ঠানিকাভাবে সচল করা হয়। বাকি শুল্ক স্টেশনগুলো দিয়ে কোনো রকম আমদানি-রফতানি হয় না। এগুলো কাগজে-কলমেই শুধু শুল্ক স্টেশন।

যদিও গত অক্টোবরের অপর এক বৈঠকে ঘোষিত পাঁচটি এলসি স্টেশনকে প্রজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়েও এনবিআর থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে মাতারবাড়ী, রামপাল, বিএম এনার্জি এলপিজি টার্মিনাল, জেএমআই এলপিজি টার্মিনাল, ইউনিটেক্স এলপিজি টার্মিনাল ও প্রিমিয়ার এলপিজি টার্মিনাল। সবকিছু মিলিয়ে এনবিআর অর্ধশতাধিক শুল্ক স্টেশন সচল রাখার উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এনবিআরসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে কোনো রকম আমদানি কিংবা রফতানি হয়নি এমন তালিকার উল্লেখযোগ্য শুল্ক স্টেশনগুলো মধ্যে রয়েছে- ডোরা বাজার, পাকশী, আশুগঞ্জ, বরিশাল, চরমুগুরিয়া, গোয়ালন্দ, শংকর, শিবগঞ্জ, নীদপুর, প্রেমতলী, ধামরহাট, ঈশ্বরদী, বগুড়া, সান্তাহার, নেকমর্দ, নীলফামারী, মোগলহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উখিয়া ঘাট, চৌমুহনী, শুভপুর, সিলেটের শেওলা, কুমার ঘাট, লাতু, ফেঞ্চুগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, সরিষাবাড়ী, ভৈরব, ময়মনসিংহ, মীরকাদিম, মুন্সিগঞ্জ, লৌহজং, আরিচা ঘাট, রংপুর ও শ্রীপুর।

এর আগে ২০০৭ সালের  জুলাই মাসে ৫০ শুল্ক স্টেশন অকার্যকর ঘোষণা করে তা স্থায়ীভাবে বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকায় যেসব শুল্ক স্টেশন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হলো- ডোরা বাজার, পাকশী, বরিশাল, চরমুগুরিয়া, গোয়ালন্দ, শংকর, শিবগঞ্জ, নীদপুর, প্রেমতলী, ধামইরহাট, বগুড়া, সান্তাহার, নেকমর্দ, নীলফামারী, মোগলহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উখিয়া ঘাট, চৌমুহনী, শুভপুর, কুমারঘাট, লাতু, কুমিল্লা, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, সরিষাবাড়ী, ভৈরব, ময়মনসিংহ, মীরকাদিম, মুন্সিগঞ্জ, লৌহজং, আরিচাঘাট, রংপুর, আনমুরা রেলস্টেশন ও শ্রীপুর।

এরপর ২০১২ সালেও আবার উদ্যোগ নেওয়া হয়। অকার্যকর শুল্ক স্টেশন বন্ধ করতে এনবিআরের গঠিত কমিটি একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছিল। পরে আর অগ্রগতি হয়নি। এমনকি ২০১৮ সালেও আরও একবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো শুল্ক স্টেশনই বিলুপ্ত করা হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা অর্থমন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন এনবিআর কোনো পক্ষই একমত হতে পারেনি।

এ বিষয়ে এনবিআরের কাস্টম বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, এনবিআর এককভাবে কোনো শুল্ক স্টেশন সরাসরি বন্ধ করতে পারে না। সরকারের সিদ্ধান্তের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের লক্ষ্য হয় দীর্ঘদিন আগের ঘোষণাকরা শুল্ক স্টেশনগুলো চালু হোক, না হলে স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হোক। যেখান দিয়ে আমদানি বা রফতানির কোনো সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই, তা কাগজে-কলমে রাখার কি দরকার।

আরএম/এসএম