ঋণগ্রস্ত ও মামলায় জর্জরিত রবি আজিয়াটা লিমিটেড। বিশেষ সুবিধায় প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে (আইপিও) ফিক্সপ্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এ কোম্পানির সর্বশেষ অর্থবছরে শেয়ারপ্রতি আয় হয়েছে (ইপিএস) মাত্র চার পয়সা।

বিনিয়োগকারীরা রবির শেয়ারকে এখন হট আইটেম বলছেন। শেয়ারটি জানুয়ারিতে ২০০ টাকা, মার্চে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায় ঠেকবে— এমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (২৬ জানুয়ারি), ১০ টাকা মূল্যের রবির শেয়ার গত ১৪ জানুয়ারি লেনদেন হয়েছে ৭০ টাকা ১০ পয়সায়। যা ওই সময়ের সর্বোচ্চ লেনদেন। অর্থাৎ সাত গুণের বেশি দাম বাড়ে।

রবি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকার তহবিল সংগ্রহ করে। আইপিওর ৫১৫ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৪ টাকা দিয়ে নেটওয়ার্ক পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। বাকি আট কোটি দুই লাখ নয় হাজার ৭৬৬ টাকা আইপিও বাবদ খরচ ধরেছে...

ঊর্ধ্বগতির এ ধারা আর ধরে রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০ জানুয়ারি রবির শেয়ারের লেনদেন হয়েছে ৬৩ টাকা ১০ পয়সায়, ২৫ জানুয়ারি লেনদেন হয়েছে ৫৪ টাকা ৭০ পয়সায় এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) লেনদেন হয়েছে ৫০ টাকা ৪০ পয়সায়। অর্থাৎ দিন যত যাচ্ছে এর দামও তত কমছে। এরপরও গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কিছু মহল।

কমিশনের উচিত রবিসহ যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে উত্থান-পতন হচ্ছে তার তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা

ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রবি আর গ্রামীণফোন কোম্পানি এক নয়। ২০১৭ সালে কোম্পানিটি লোকসানে ছিল, ২০১৮ সালে কিছুটা উন্নতি হলেও ২০১৯ সালে এর ইপিএস দেখানো হয়েছে মাত্র চার পয়সা। তবে এখন যেভাবে শেয়ারটির দাম বাড়বে বলে গুজব ছড়ানো হচ্ছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মূলত বিনিয়োগকারীরাই।

ফেসবুকে ছড়ানো গুজব, সাবধান থাকতে বলছেন বিশ্লেষকরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম- ফেসবুকে ‘রবির শেয়ার বহু দূর যাবে’ বলে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এম এ করিম শেখ নামের একজন ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্যপরিষদ’ নামের পেজে লিখেছেন, ‘আগামী ২৮ জানুয়ারির মধ্যে শেয়ারটি ১৯ দশমিক ৮৬ গুণ বেড়ে ১৯৮ টাকা ৬১ পয়সায় কেনা-বেচা হবে।’ অর্থাৎ শেয়ারটির দাম আরও ১৩০ টাকা বাড়বে।

‘ডিএসই ইনভেস্টরস ক্লাব’ নামের আরেকটি গ্রুপে সিলিভা খান লিখেছেন, ‘রবির শেয়ার আগামী মার্চে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত যাবে’। ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী জোট’-এ আয়মান তালুকদার পোস্ট করেছেন, ‘রবির এয়ার ক্লোজিং ডিসেম্বর। তার মানে, সামনে ভালো ডিভিডেন্ডের খেলা হবে…।’ 

রবি আর গ্রামীণফোন এক নয়। যদি একই হতো তা হলে রবি প্রিমিয়ামে বাজারে আসত। এখান থেকেই বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। পুঁজি বাঁচাতে হলে বিনিয়োগকারীদের এসব শেয়ারে বিনিয়োগ পরিহার করতে হবে

অধ্যাপক আবু আহমেদ, পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ

এভাবে বিনিয়োগকারীদের আরও বেশি বিনিয়োগের জন্য গুজব ছড়ানো হচ্ছে। তবে ‘উই ওয়ান্ট টু বি গেইনার’ গ্রুপে ‘রবির খেইল খতম আগামীকাল?’— এমন পোস্ট করে বিনিয়োগকারীদের সতর্কও করা হয়েছে। 

টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানিটির ২০১৯ সালে ইপিএস ছিল চার পয়সা। এ সময় শেয়ারপ্রতি নিট সম্পদ (এনএভিপিএস) ছিল ১২ টাকা ৬৪ পয়সা। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে (নয় মাসে) কোম্পানিটির ইপিএস দেখানো হয়েছে ২৬ পয়সা। বিদায়ী বছরে প্রতিষ্ঠানটি ভালো মুনাফা করবে, সে সম্ভাবনাও নেই। অথচ শেয়ারটির দাম বাড়তে গুজব রটানো হচ্ছে।

অস্বাভিক এমন দাম বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য আছে কি-না, জানতে চেয়ে ডিএসই ও সিএসই রবিকে চিঠি দিয়েছে। উত্তরে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, কোম্পানির কাছে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। তারপরও শেয়ারের দাম বাড়ছে। পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনও (বিএসইসি) মনে করছে, এর পেছনে কারসাজি হচ্ছে। তাই স্টক এক্সচেঞ্জকে গত মঙ্গলবার অস্বাভাবিক হারে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি তদন্ত করতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু পরের দিনই (বুধবার) কোনো এক অদৃশ্য শক্তির কারণে তদন্ত না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

যারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব ছাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে

শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ, কমিশনার, বিএসইসি

এ অবস্থায় কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, কোম্পানিটির শেয়ার অস্বাভাবিক হারে বাড়ার পেছনে কোনো সিরিয়াল ট্রেডিং হচ্ছে কি-না, দ্রুত কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে। কেউ জড়িত থাকলে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নিতে হবে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশনের উচিত রবিসহ যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে উত্থান-পতন হচ্ছে তার তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা।

‘পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের উচিত ইপিএস কম থাকা কোম্পানির শেয়ার বাদ দিয়ে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা। এ কারণেই ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে ধস নেমেছিল। বাজার যাতে আবারও ধসের দিকে না যায় সেই চিন্তা মাথায় রাখতে হবে।’

২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে রবি আজিয়াটার দুই হাজার ১৪০ কোটি ৯৪ লাখ ৪ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণ এক হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৫ সালের ২২ অক্টোবর ব্যবসা শুরু করা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ভ্যাট, শুল্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ৫০০ মামলায় রয়েছে...

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘রবি আর গ্রামীণফোন এক নয়। যদি একই হতো তা হলে রবি প্রিমিয়ামে বাজারে আসত। এখান থেকেই বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। পুঁজি বাঁচাতে হলে বিনিয়োগকারীদের এসব শেয়ারে বিনিয়োগ পরিহার করতে হবে।’

অস্বাভাবিক দামি বৃদ্ধির পাশাপাশি ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর বিষয়ে বিএসইসির কমিশনার শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, কমিশন আপাতত তদন্ত বন্ধ রেখেছে। তবে এ কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি দেখতে পেলে প্রয়োজনে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করব। যারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব ছাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ফেসবুকে ছড়ানো গুজব, সাবধান থাকতে বলছেন বিশ্লেষকরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

২০১৯ সালের আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে রবি আজিয়াটার দুই হাজার ১৪০ কোটি ৯৪ লাখ ৪ হাজার টাকার ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদের ঋণ এক হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৫ সালের ২২ অক্টোবর ব্যবসা শুরু করা কোম্পানিটির বিরুদ্ধে ভ্যাট, শুল্কসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রায় ৫০০ মামলায় রয়েছে।
 
বিশেষ সুবিধায় রবির আইপিও অনুমোদন

কর্মকর্তাদের প্লেসমেন্ট সুবিধা দিয়ে বিএসইসি রবি আজিয়াটাকে আইপিওর অনুমোদন দেয়। এছাড়া ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) নির্দেশনা অমান্য করে ২০২০ সালের নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) ব্যবসায় শেয়ারপ্রতি মুনাফা (ইপিএস) বাড়িয়ে দেখিয়েছে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিটি। ইপিএস গণনায় শেয়ার মানি ডিপোজিট বা অনুরূপ যেকোনো নামে সংগ্রহ করা অর্থকে বিবেচনায় নিতে বলা হলেও রবি তা নেয়নি। এর মাধ্যমে কোম্পানিটি অতিরঞ্জিত ইপিএস দেখিয়েছে। যা নিয়ে এফআরসি করণীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। কিন্তু কমিশন কোম্পানিটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

এফআরসি প্রকাশিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শেয়ার ইস্যু করা হবে— এমন প্রতিশ্রুতিতে ‘শেয়ার মানি ডিপোজিট’ বা অনুরূপ অন্য যেকোনো নামে সংগ্রহ করা অর্থ নিয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন কৌশলে অপব্যবহার করা হয়। এ সমস্যা কাটিয়ে তোলার জন্য ইপিএস গণনায় ওই অর্থকে বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে এফআরসি।

গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর রবিকে পুঁজিবাজার থেকে টাকা তোলার অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ১৭ থেকে ২৩ নভেম্বর বিনিয়োগকারীরা রবির শেয়ারের জন্য আবেদন করেন এবং ১০ ডিসেম্বর লটারি অনুষ্ঠিত হয়। ২০ ডিসেম্বর বিনিয়োগকারীদের বিও অ্যাকাউন্টে শেয়ার যোগ হয়। রবির শেয়ার পান চার লাখ ৬৫ হাজার বিনিয়োগকারী। আবেদন করেন ১২ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী।

রবি আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে ৫২৩ কোটি ৭৯ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪০ টাকার তহবিল সংগ্রহ করে। আইপিওর ৫১৫ কোটি ৭৭ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৪ টাকা দিয়ে নেটওয়ার্ক পরিধি বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে রবির। বাকি আট কোটি দুই লাখ নয় হাজার ৭৬৬ টাকা আইপিও বাবদ খরচ ধরেছে।

এমআই/এমএআর/