অনিয়ম-দুর্নীতি আর জালিয়াতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা-পরিচালকরা। নামে-বেনামে নানা অব্যবস্থাপনায় দেওয়া ঋণ আর ফেরত আসছে না। ফলে অর্থ আদায়ে বাধ্য হয়ে মামলা করছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) এমন ১৭ হাজার ৪৩২টি মামলা এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। এসব মামলার বিপরীতে আটকা আছে প্রতিষ্ঠানগুলোর ১০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ষাণ্মাসিক প্রতিবেদন থেকে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত আর্থিক খাতের মামলার সংখ্যা এবং মামলার কারণে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ তুলে ধরা হয়েছে। সাধারণত যেসব খেলাপি ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম সেগুলো আদায়ের জন্যই ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আদালতে মামলা করে থাকে।

• বিচারাধীন ১৭ হাজার ৪৩২টি মামলা
• নিষ্পত্তিতে প্রয়োজন ‘বিশেষ আদালত’ 

পুনঃতফসিল পুনর্গঠন ও এককালীন পরিশোধসহ গত এক দশকে ঋণখেলাপিদের জন্য একাধিক  বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তারপরও ঋণ পরিশোধ হচ্ছে না। ক্রমাগত বাড়ছে খেলাপি ঋণ। অন্যদিকে দু-একটি ঘটনা ছাড়া ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণও তেমন চোখে পড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে মামলাজট কমাতে স্পেশাল কোর্ট (বিশেষ আদালত) চালুর পাশাপাশি সরকারের পক্ষ থেকে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ আদায়ে সাধারণত চার ধরনের আদালতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। আদালতগুলো হলো- অর্থঋণ, দেউলিয়া, সার্টিফিকেট ও দেওয়ানি আদালত। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতেই বেশির ভাগ মামলা দায়ের হয়। এ আদালতেই এনবিএফআইয়ের অধিকাংশ অর্থ আটকা আছে।

অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আদালতে দায়ের ও নিষ্পত্তি মামলা সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আদালতে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা (ক্রমপুঞ্জিভূত) ২৮ হাজার ২০৭টি। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১২ হাজার ৮৯০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ হাজার ৭৭৫টি মামলা; যেখানে অর্থের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২৫৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। জুন শেষে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ১৭ হাজার ৪৩২টি। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার ৬৩২ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আদালতে মামলা করে বছরের পর বছর খেলাপি ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ায় সংকট আরও প্রকট হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়া দেশে এতটাই অকার্যকর এবং বিচারের যে দীর্ঘসূত্রতা, ফলে হাজার হাজার কোটি টাকা আটকা আছে মামলাজটে। বছরের পর বছর ধরে এ সুযোগ নিচ্ছেন রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা। আদালতে মামলাগুলো ঝুলিয়ে রেখে বহাল তবিয়তে ব্যবসা  ও রাজনীতি করে যাচ্ছেন তারা। অনেকে আবার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, এমনকি পরিচালক হয়ে বছরের পর বছর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাই সংকট নিরসনে মামলার দীর্ঘসূত্রতার নিরসন প্রয়োজন। এটি করতে না পারলে ভবিষ্যতে সংকট মহামারির আকার ধারণ করবে।

দেশে এখন ব্যাংকবহির্ভূত ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ ঋণ শ্রেণিকরণের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ প্রান্তিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৬৬ হাজার ৯৬২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ শ্রেণিকরণ বা খেলাপি হয়েছে ১০ হাজার ৩৫৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যা বিতরণ করা ঋণের ১৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ। খেলাপি ঋণের মধ্যে মন্দ ঋণের (ব্যাড লোন) পরিমাণ সাত হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানির (আইআইডিএফসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মামলা বাড়ছে কিন্তু কোর্টের (আদালত) সংখ্যা বাড়েনি। ফলে মামলাজট বেড়েছে। ব্যাংক, বিমাসহ পুরো আর্থিক খাতের লাখ লাখ মামলা একই কোর্টে পরিচালিত হচ্ছে। মামলা নিষ্পত্তির জন্য আইনে একটা সময় দেওয়া আছে। কিন্তু মামলা বেশি হওয়ায় তারিখ অনেক সময় নিয়ে নির্ধারণ করা হচ্ছে। ফলে মামলাগুলো ঝুলে যাচ্ছে।’ 

এছাড়া মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বেশ লম্বা। বিচারক ইচ্ছা করলেও রায় দিতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন কোর্ট বন্ধ ছিল। এ কারণে সমস্যাও বেড়েছে। সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ স্পেশাল কোর্ট (বিশেষ আদালত) চালু করা। তা না হলে সমস্যা দিন দিন বড় হবে।

বিশেষ আদালতের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে স্পেশাল কোর্ট চালুর ব্যবস্থার কথা বলেছি। যেখানে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মামলাগুলো নিষ্পত্তি হবে। তা না হলে মামলা বাড়তেই থাকবে, সংকটও বাড়বে।’

আইআইডিএফসি এমডি আরও বলেন, ‘নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন হচ্ছে। সেখানে ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে চিহ্নিত করে সরকার শাস্তি দেবে। এসব খেলাপি বিদেশে যেতে পারবে না। তাদের পাসপোর্ট জব্দ করা হবে। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে। এসব আইন যদি কার্যকর হয় তাহলে খেলাপির সংখ্যা কমে আসবে।’

এজন্য দুটি বিষয় দরকার। এক, সরকারের পক্ষ থেকে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এবং দুই, স্পেশাল কোর্ট চালু করা— বলেন গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মোট মামলার সংখ্যা দুই লাখ এক হাজার ৫৮৬টি। এসব মামলার সঙ্গে জড়িত অর্থের পরিমাণ এক লাখ ৯৫ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। তবে জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছে এমন মামলার সংখ্যা এক লাখ ৩৬ হাজার। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে মোট ১৯ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। সেই হিসাবে জুন শেষে অর্থঋণ আদালতে আটকা এক লাখ ৭৬ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা।

এসআই/এমএআর/