একযুগ আগেও বাচ্চাদের খেলনা চাহিদার ৯৫ শতাংশ পূরণ হতো চীন থেকে আমদানির মাধ্যমে। আর মাত্র পাঁচ শতাংশ চাহিদার সক্ষমতা ছিল স্থানীয় খেলনা শিল্পের। এরপর দেশীয় উদ্যোক্তাদের পরিশ্রমে ধীরে ধীরে প্লাস্টিক খেলনাসহ এ খাতে নিজেদের আধিপত্য বৃদ্ধি করতে থাকে স্থানীয় উদ্যোক্তারা।

এখন ৯৫ শতাংশ প্লাস্টিক খেলনার চাহিদা পূরণ করে দেশীয় কারখানা। শুধু দেশীয় চাহিদা পূরণ নয়, এখন বিদেশেও রফতানি করার সক্ষমতা রয়েছে তাদের। বাংলাদেশ টয় মার্চেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন তথ্যানুসারে বর্তমানে দেশ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার খেলনা বিদেশে যাচ্ছে।

বর্তমানে ছোট বড় ১৫০টির বেশি কারখানা খেলনা উৎপাদন করছে। যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাব জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। আর্থিক হিসাবে সব মিলিয়ে খেলনা শিল্পের সার্বিক বাজার ৬ হাজার কোটি টাকার মতো।

সরকারের আওতাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ব্যবসাবান্ধব শুল্ক নীতির কারণেই দেশীয় খেলনা শিল্প শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েছে বলে মনে করে সংশ্লিষ্টরা। ২০১৫ সালে খেলনার বিভিন্ন উপকরণে আমদানি শুল্ক কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছিল। শর্ত সাপেক্ষে আরও বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া যাবতীয় মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটও প্রত্যাহার হয়।

দেশীয় খেলনা শিল্পকে আরও এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুকারক ও রফতানীকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) উদ্যোক্তাদের আরও কিছু উপকরণের ক্ষেত্রেও এমন সুবিধা দাবি করা হয়।

কিন্তু চলতি বছরের ২৭ জুন ঘটলো অদ্ভূত ঘটনা।প্লাস্টিক শিল্পের উপ-খাত খেলনা প্রস্তুতকারীদের জন্য জারি করা রেয়াতী প্রজ্ঞাপনে আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ রেখে কৌশলে খেলনার উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ ও সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশসহ মোট শুল্ক ও করসহ প্রায় ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এমন ঘটনায় দেশীয় খেলনা শিল্প বিশেষ করে প্লাস্টিক খেলনা প্রস্তুতকারীদের মাথায় যেন বাজ পড়ল। উপকরণের এমন শুল্ক পরিশোধ করে স্থানীয় খেলনা শিল্পের অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।

এ অবস্থায় বিপিজিএমইএ খেলনা শিল্পের উদ্যোক্তরা এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিম বরাবর সংকট উত্তরণে পদক্ষেপ চেয়ে কয়েক দফা চিঠি দিয়েছে।

চিঠিতে বিপিজিএমইএ’র সভাপতি সামিম আহমেদ বলেছেন, প্লাস্টিক শিল্পের খেলনা শিল্পের উপকরণ ও যন্ত্রাংশ আমদানিকালে শুল্কায়নে এরূপ বৈসাদৃশ্য ও একই প্রজ্ঞাপনে দুই ধরনের শুল্কায়ন পদ্ধতির কারণে খেলনা শিল্পের বিপিজিএমইএ’র সদস্য উদ্যোক্তারা ভোগান্তি সম্মুখীন হচ্ছেন। দেশীয় শিল্পের উপকরণ ও যন্ত্রাংশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক-কর আরোপ দেশের নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই শ্রমধন খেলনা শিল্প রক্ষায় শুল্ক অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপনটি সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ততম খেলনা সামগ্রীর বাজার পুরনো ঢাকার চকবাজারে। ঐতিহাসিকভাবেই চকবাজার রকমারি পণ্যের প্রধান পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত, তবে এখন পুরো চকবাজারজুড়ে গড়ে উঠেছে খেলনার কয়েকশ পাইকারি দোকান। বিক্রেতারা বলছিলেন, কয়েক বছর আগেও প্লাস্টিকের খেলনার প্রায় পুরোটাই আসতো চীন থেকে। কিন্তু এখন সেই বাজারে বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে বাংলাদেশে তৈরি খেলনা।

২০১৪ সাল থেকে রাজধানীর চকবাজারে বিভিন্ন ধরনের খেলনা প্রস্তুত করে আসছেন আমান প্লাস্টিক টয়েস ইন্ডাষ্ট্রিজ। প্রায় ২ হাজার নারী-পুরুষ তার কারখানায় কাজ করছেন। তিলে তিলে গড়া নিজের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমানও যত দ্রুত সম্ভব শুল্ক প্রত্যাহার চেয়েছেন।

এ বিষয়ে খেলনা উৎপাদনকারী সমিতির নির্বাহী সদস্য ও আমান প্লাস্টিক টয়েস ইন্ডাষ্ট্রিজ মালিক মো. আমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০০৮ সালে যখন ব্যবসা শুরু করি তখন ৯৫ শতাংশ খেলনা আসতো চীন থেকে। এখন ৯৫ শতাংশ খেলনা দেশীয় কারখানায় ‍প্রস্তুত হয়। সরকার সব সময় দেশীয় উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু দুই-একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারণে শ্রমঘন এমন খাতকে সংকটের দিক ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সহযোগিতায় খেলনা শিল্প এ অবস্থানে আসছে। সরকার যদি একটু সহযোগিতা করে তাহলে বেঁচে যাই। এ সেক্টরে ৩৫ হাজার শ্রমিক সরাসরি কাজ করছে। এছাড়া লিংকেজ অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।

এনবিআর চেয়ারম্যান বরাবর খেলনা প্রস্তুতকারকদের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ উৎসাহিত ও কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে বর্তমান সরকার ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক ব্যবসা বান্ধব ও গণমুখী সিদ্ধান্ত নেয়। স্থানীয় শিল্পের বেশ কয়েকটি খাতের সহায়তার লক্ষ্যে শিল্পের উপকরণের যন্ত্রাংশ ও যন্ত্রপাতির ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক, রেগুলেটরি ডিউটি ও আমদানি শুল্ক ছাড় দিয়ে রেয়াতী প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই সহায়তা নীতির ধারাবাহিকতায় প্লাস্টিক শিল্পের উপ-খাত খেলনা প্রস্তুতকারীদের জন্য গত ২৭ জুন (প্রজ্ঞাপন নং ২২০/আইন /২০২১ / ২৮ / কাস্টমস) একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই প্রজ্ঞাপনে খেলনার উপকরণ আমদানিতে রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ ও সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ বিদ্যমান থাকায় উপকরণের ওপর সর্বমোট আমদানি শুল্ক ও করাদির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ শতাংশ। এর ফলে উপকরণে এমন শুল্ক পরিশোধ করে স্থানীয় শিল্পের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে ।

চিঠিতে আরও বলা হয়, শিল্পের উপকরণ আমদারিতে রেগুরেটরি ডিউটি এবং সম্পূরক শুল্ক আরোপের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার অনুরোধ করছি। একই সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি ৩ শতাংশ এবং সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ মওকুফ করে নতুন রেয়াতী প্রজ্ঞাপন জারি করা হলে উদীয়মান খেলনা শিল্প খাতটি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে  এবং চলমান অর্থনিতিক অবদান রাখতে সক্ষম হবে।

এর আগে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুকারক ও রফতানীকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমইএ) থেকেও গত ২২ সেপ্টেম্বর এমন দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআইকে অবহিত করা হয়েছিল।

খেলনার শুল্ক জটিলতা বিষয়ে জানতে এনবিআর সদস্য (শুল্কনীতি ও আইসিটি) সৈয়দ গোলাম কিবরীয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনা এসেছে। বিষয়টি আমরা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করছি।

খেলনা একটি শ্রমঘন শিল্প। যার মাধ্যমে বাংলাদেশে এ খাতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি খেলনার বিশ্ববাজারের আকারও বিশাল। এদেশে মজুরি কম হওয়ায় বিদেশি খেলনা উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে কারখানা করছে। প্লাস্টিকের পুতুল থেকে শুরু করে নানান ধরনের গাড়ি, ফিশিং গেম, গিটার, রাইফেল, অ্যাম্বুলেন্স, মোবাইলসহ বিভিন্ন যন্ত্রের রেপ্লিকার মতো খেলনাগুলো এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে দেশীয় পর্যায়ে ১৫০০ ধরনেরও বেশি খেলনা বানানো হচ্ছে। শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাব জড়িত প্রায় ১০ লাখ মানুষ। ঢাকার আশপাশে গড়ে ওঠা ছোট-বড় প্রায় ১৫০টি কারখানায় খেলনা বানানো হয়। ওসব কারখানাই দেশের ছোট খেলনার প্রায় ৮০ শতাংশের সরবরাহকারী। গত এক দশকে সেগুলো ছোট কারখানা থেকে বড় শিল্প কারখানায় রূপ নিয়েছে।

আরএম/এসএম