বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হচ্ছে ‘জন-শুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’। কিন্তু ২০২১ সালের শেষে এসেও ‘২০২১’ নাম দেওয়া প্রকল্পটির দৃশ্যমান কোনো কাজই শুরু করতে পারেনি বিবিএস। একেরপর এক নতুন সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের আগমন-বদলিতে থমকে আছে প্রকল্পের ভাগ্য।

বিবিএসের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি হাতে নেওয়ার শুরুতে তৎকালীন (২০২০ সাল) সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তী এবারের জনশুমারি ২০১১ সালে ন্যায় ইন্টেলিজেন্ট ক্যারেক্টার রিকোগনিশনের (আইসিআর) পাশাপাশি দুটি জেলায় ট্যাবের মাধ্যমে ডিজিটালি করতেই উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠায় বিবিএস। এ প্রকল্পটির ডিপিপি প্রণয়নের তিন বছর আগে থেকে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে জনশুমারির জন্য একটি মাস্টার প্ল্যানও তৈরি করে বিবিএস। পরবর্তী সময়ে ওই মাস্টার প্ল্যান বিবিএস সচিবের মাধ্যমে অনুমোদিত হওয়ার পর জনশুমারি প্রকল্পের মূল ডিপিপি তৈরি করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় পরিকল্পনা কমিশন হয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা-২০২১’ প্রকল্পটি অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একনেকে অনুমোদনের পর মূল কাজ আইসিআরের মাধ্যমে করার জন্য প্রকল্পের আওতায় থাকা প্রায় সবকিছু কেনাকাটাও করা হয়। 

আরও পড়ুন : ক্রয় কমিটি থেকে আবারও ফেরত বিবিএসের প্রস্তাব

কর্মকর্তারা আরও জানান, সচিব সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীর অবসরে (৩০ জুন, ২০২০ সাল) যাওয়ার পর এবং করোনা মহামারির ফলে প্রকল্পের ভবিষ্যত ঝুলে যায়। কারণ সচিবের অবসরের পর নতুন সচিব মুহাম্মদ ইয়ামিন চৌধুরী দায়িত্ব নিয়ে (১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০) তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক মো. জাহিদুল হক সরদারকে সরিয়ে দেন। এরপরই প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। কারণ নতুন পিডি দায়িত্ব নিয়েই আইসিআর পদ্ধতি বাদ দিয়ে মূল শুমারির কাজ ট্যাবের মাধ্যমে ডিজিটালি করতে ডিপিপি সংশোধন করে। এর ফলে আইসিআর মেশিনে শুমারির জন্য ক্রয় করা সব উপকরণই অকেজো হয়ে বিবিএসে পড়ে আছে। অকেজো হয়ে পড়ে থাকা এ উপকরণ ক্রয়ে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০৫ কোটি টাকা। শুমারির কাজ আইসিআর থেকে ট্যাবে রূপান্তরের কারণে সরকার তথা রাষ্ট্রের গচ্ছা যাচ্ছে ১০৫ কোটি টাকা এমনই তথ্য জানিয়েছেন বিবিএসের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা। শুমারি করার মতো সব উপকরণ থাকলেও এগুলো ফেলে দিয়ে মূল ডিপিপির অনেক অংশ বাদ দিয়ে আন্তঃসমন্বয়ের মাধ্যমে ট্যাব ক্রয়ের জন্য অতিরিক্ত আরও সাড়ে ৫০০ কোটি টাকার আবদার করেন বর্তমান পিডি। প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আবদারের পরিপ্রেক্ষিতে ডিপিপি সংশোধনে অনুমোদন করেন পরিকল্পনামন্ত্রী।

বিবিএসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, ট্যাব শুমারিতে বড় মুনাফা করতে চাইছে বর্তমান প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কারণ প্রায় ৪ লাখ ট্যাব কেনার কাজটি তারা একটি কোম্পানিকে দিতে চায় এবং সেভাবেই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ টেন্ডার স্পেসিফিকেশন তৈরি করেছে। যার ফলে বিবিএস ট্যাব কেনার প্রস্তাব বারবারই সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি থেকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ট্যাব কেনার প্রস্তাবটি তৃতীয়বারের মতো বৃহস্পতিবার (২৫ নভেম্বর) পারচেজ কমিটিতে তোলা হবে। এবারও নানা ধরনের ত্রুটি নিয়ে পারচেজ কমিটিতে প্রস্তাবটি পাঠানো হয়েছে। এবারের প্রস্তাবেও সংশোধিত ডিপিপির নির্দেশনা মানা হয়নি। এবার যেভাবে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, এভাবে ট্যাব কিনতে চাইলে একনেকে ডিপিপি আবার সংশোধন করতে হবে। নিয়ম-নীতি অনুসরণ না করেই কাজ করতে চাইছে বিবিএস।  

আরও পড়ুন : বিবিএসের ‘ট্যাব’ রি-টেন্ডারেও প্রশ্ন, আছে ‘ষড়যন্ত্রের’ গন্ধও

এ প্রসঙ্গে পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি এ বিভাগে একদম নতুন এসেছি। যার ফলে এখনও জনশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পটি নিয়ে সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। এক সপ্তাহ হলো আমি এখানে যোগদান করেছি। যেহেতু আমি আপনার সব প্রশ্নের সকল উত্তর দিতে এখনও নিজেকে সেভাবে তৈরি করতে পারিনি সেজন্যই এ মুহূর্তে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না।’

দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম ফাইলের কিছু ত্রুটি নির্ণয় করে পরিকল্পনামন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছিলেন।

ক্রয় কমিটিতে বিবিএসের পাঠানো প্রস্তাবে যেসব ত্রুটি নির্ণয় করেছেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী-

ক. আরডিপিপির ট্যাবলেট স্পেসিফিকেশন অংশে ‘এমডিএম সফটওয়্যার মাস্ট বি হোস্টেড ইন বিবিএস সার্ভার’ উল্লেখ করা থাকলেও ডিপিপি পরিবর্তন না করে পুনঃদরপত্রের কারিগরি বির্নিদেশে ‘এমডিএম সফটওয়্যার ভিয়া কুড কন্ট্রোলিং অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

খ. যেহেতু ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেড কর্তৃক ডিপিপি অনুযায়ী এমডিএম সফটওয়্যারটি বিবিএস সার্ভার এ হোস্টেড করতে সক্ষম নয়, তাই অনুমোদনবিহীনভাবে কুড কন্ট্রোলিং অর্ন্তভুক্ত করে ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স লিমিটেডকে রেসপনসিভ দেখাতে চাচ্ছে।

গ. আহ্বানকরা পুনঃদরপত্রের কারিগরি বির্নিদেশ টেকনিক্যাল কমিটি দ্বারা অনুমোদিত নয়।

প্রতিমন্ত্রীর চোখে আরও ধরা পড়েছে, ‘আরডিপিপির ট্যাবলেট স্পেসিফিকেশন অংশে এমডিএম সফটওয়্যার বিবিএসের সার্ভারে হোস্ট করার কথা বলা হলেও আরডিপিপি সংশোধন না করে আহ্বান করা পুনঃদরপত্রে বলা হয়েছে ‘এমডিএম সফটওয়্যার উইল বি এক্সসেপ্টেড ভিয়া কুড কন্ট্রোলিং’ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতি সংক্রান্ত পরিপত্রের ব্যত্যয় হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়। পুনঃদরপত্রের টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন সংশ্লিষ্ট পৃষ্ঠাগুলোতে কারও স্বাক্ষর নেই এবং লক্ষণীয় ‘প্যারাফ্রেজিং’ পরিবর্তন করা হয়েছে। এতে পুনঃদরপত্রে আরডিপিপি অনুসরণ না করায় সংগৃহীত জাতীয় তথ্য-উপাত্তের নিরাপত্তা ও পণ্যের গুণমান নিশ্চিত নাও হতে পারে। বিষয়টি মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে সদয় গোচরীভূত করা হলো।’

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সর্বশেষ বিনীতভাবে পারচেজকে বলেছি, আপনারা যাই সিদ্ধান্ত নেন সমস্যা নাই। তবে যাই করার দ্রুতই করেন। কারণ শুমারির কাজটা পিছিয়ে গেছে। আমি পারচেজ এ বক্তব্য রাখবো এবং বলবো, আমি এ বিষয়ে এক্সপার্ট নই। কমিটি যেই সিদ্ধান্ত দেবে আমি সেটাই মানবো। তবে আমি চাই এটা আর যেন দেরি না হয়।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ট্যাবের ফাইলে কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন, টেন্ডারের স্পেসিফিকেশন পরিবর্তন ও টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ না থাকা বা টেকনিক্যাল কমিটির কোনো সদস্য ট্যাব কেনার এ প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেনি এমন প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী নজরে যেগুলো এসেছে সেগুলো উনি বলেছেন বা তুলে ধরেছেন। বাকিটা পারচেজ কমিটি বিবেচনা করুক। পারচেজ কমিটির সভায় সেন্ট্রাল প্রকিউর টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) মহাপরিচালক এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব উপস্থিত থাকবেন। সিপিটিইউ ও আইএমইডি তাদের টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়ে সভায় মতামত দেবে।’

এসআর/এসএম